Logo
শিরোনাম

চাল-ডালে হৈ চৈ ডিমে উত্তাপ

প্রকাশিত:শনিবার ০৪ জুন ২০২২ | হালনাগাদ:মঙ্গলবার ১৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮৪৫জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

কয়েকমাস ধরে অস্বাভাবিক চড়া নিত্যপণ্যের বাজার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। তেল-আটা-ময়দার পর এবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে চালের বাজারেও। যেন নৈরাজ্য চলছে চাল-ডাল-ডিমসহ নিত্যপণ্যের বাজারে। উৎপাদন বন্ধ করে যে যেভাবে পারছেন ধান মজুদ করছেন। ঘাটতির অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চালসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দর। এখনই এর লাগাম টানতে না পারলে সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, নওগাঁ বাইপাস সড়ক সংলগ্ন একটি চালকলে এখনো পুরাতন চাল পাওয়া যাচ্ছে। মূলত এটি নামেই চালকল, বছরজুড়ে এখানে চলে মজুদদারি। সূত্র মতে, নতুন করে চলতি মৌসুমের ধান মজুদ হচ্ছে চালকলটিতে। পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন মিল মালিকরা। এখন তাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৭-৮টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান যোগ হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যোগসাজশ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রায় প্রতিদিনই বাড়াচ্ছে চালের দাম।

বাংলাদেশ হাসকিন মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, বোরোর মৌসুমে দেশে সব সময় চালের দাম কমে। কখনো দেখিনি চালের দাম বেড়েছে। এবার তা দেখতে হচ্ছে। তিনি জানান, বড় কিছু কোম্পানি ধান-চালের অবৈধ মজুদ গড়ে তুলছেন। এ কারণে বাজারে চালের দাম বাড়তি। পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরা বাজারে সব ধরনের চাল আরো ৫-৬ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চালের দাম বাড়ানো হয়। এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, এর আগে তো মিলাররা ছিল, তারা মজুদ করে দাম তেমন একটা বাড়াত না। যেভাবেই হোক সরবরাহ নিশ্চিত করত। এখন চালের মৌসুমেও সরবরাহ নিশ্চিত নয়। বর্তমানে ৫০ শতাংশেরও কম চাল সরবরাহ হচ্ছে। তারা বলেন, এখন বড় বড় কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় মাঝারি আকারের যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এসে এমন অবস্থা করেছে যে এমন পরিস্থিতি বিগত ৩৫ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখিনি। বাজার নিয়ন্ত্রণে মিল পর্যায়ে এখনই কঠোর নজরদারি করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের।

এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রশ্ন রেখেছেন, বাজারে এখনো পুরোনো চাল বিক্রি হচ্ছে। তাহলে নতুন ধান কোথায় যাচ্ছে? মন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও ইঙ্গিত মেলে দেশের বিভিন্ন বড় বড় চাতাল মালিক, ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় চাল মজুদ করছে। তবে এ তালিকায় বেশ কিছু বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হয়েছে। অপরদিকে মিলগেটে বেশি দামেও মিলছে না জিরাশাইল, কাটারি, নাজিরশাইল চাল। ফায়দা লুটতে দেশের করপোরেট হাউসগুলো ধান-চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় চালকল মালিকদের। মোকামগুলোতে সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজির বস্তায় চালের দর বেড়েছে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত।

জানা গেছে, গত কয়েক মাসে দফায় দফায় চালের দাম বেড়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বেশ কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মিল মালিকদের যোগসাজশে হু হু করে চালের দাম বাড়ছে। এক রাতেই রাজধানীতে পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে সরু ও মোটা চালের দাম ৩-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি কেজি মিনিকেট ৬৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৮ টাকা করেছে। ব্রি ২৮ চালের নতুন দাম ৪৮-৫৫ টাকা। এছাড়া দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও চাল না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল বিক্রেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিল থেকে প্রতি সপ্তাহে বাড়তি দরে চালের রেট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বোরো মৌসুমে এমন দাম বাড়ার চিত্র কখনো দেখিনি। এবারই প্রথম দেখলাম। মিল মালিকরা আগে দাম নিয়ে কারসাজি করলেও তাদের সঙ্গে বড় কিছু কোম্পানি যোগ হয়েছে। তারা ধান কিনে মজুদ করায় বাজারে কিছুটা ধানের সংকট হয়েছে। সেই অজুহাতে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েছে।

নওগাঁ ধান ও চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য সংকট তৈরি হবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। যে কারণে অনেকেই ভাবছেন আমাদের দেশে চালের ক্রাইসিস তৈরি হবে। সে কারণে অনেকেই অবৈধ মজুদ করছেন। এ ধরনের অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ধান উৎপাদন মৌসুমে চালের বাজার অস্থির। কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমন পরিস্থিতি হয়েছে তা বের করতে হবে। বিশ্ববাজারের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের বাজার অস্থির করতে না পারেন সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মিল থেকে শুরু করে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের বেচাকেনার রসিদ দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। ভরা মৌসুমে বাড়ছে চালের দাম। এক মাসের ব্যবধানে মান ভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ৫-১৫ টাকা বেড়েছে।

এমন অবস্থায় নিজ কার্যালয়ে বৈঠকে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অ্যাকশনে যেতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেউ অবৈধভাবে চাল মজুদ করলে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, চাল ও তেল নিয়ে মার্কেট সার্ভে করে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে বলা হয়েছে। তেলের মতো চাল ইস্যুতেও অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মজুদ করলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সভায় চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও। ওই দিন খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ধান কিনে মজুদ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছে, ভাবছে ধান কিনলেই লাভ। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো পরিণতি আনবে না। অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে নতুন চাল এখনো আসছে না। এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের পুরোনো। তাহলে নতুন ধান যাচ্ছে কোথায়? এ অবস্থা চলতে দেয়া হবে না। কে কত পরিমাণ ধান কিনছেন এবং কে কত পরিমাণ চাল ক্রাশিং করে বাজারে ছাড়ছেন তা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট আকারে পাঠানোর কথা বলেন মন্ত্রী।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হাওরে বন্যায় ৮০ হাজার টন চাল নষ্ট হওয়ার পরও এবার বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭ লাখ টনের ওপরে চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) বৈশ্বিক দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এ বছর দেড় লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হবে। এমন চিত্রের পরও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। এদিকে চাল-তেল-আটার পর এবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে ডালের বাজারেও। মাসের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। নিত্যপণ্যের ধারাবাহিকভাবে দাম বৃদ্ধিতে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকার ও আমদানিকারকদের দুষছেন খুচরা বিক্রেতারা। পাইকাররা বলছেন, বিশ্ববাজারে যে নৈরাজ্য চলছে তার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় মোকামে।

কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ইউক্রেইনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয় ডাল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাবে বেড়েছে জাহাজ ভাড়া, সঙ্গে ডলারের উচ্চমূল্য, তাই আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অস্থির ডালের বাজার। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারদের। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে, মোটা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১০০ টাকা। দেশি ও নেপালি সরু দানার মসুর ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, যা মাসখানেক আগেও পাওয়া যেত ২০ টাকা কমে। শুধু মসুর নয়, দাম বাড়ার তালিকায় আছে মুগ, ডাবলি, বুটসহ অন্যান্য ডালও। বাড়তি এই দাম পকেট কাটছে ক্রেতাদের।

টিসিবির পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে মোটা মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশ, আর মাঝারি ৪১ শতাংশ এবং ছোট দানা ২১ শতাংশ। অ্যাংকর ও ডাবলির দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ শতাংশ। এদিকে, বাজার নিয়ন্ত্রণে ৫ হাজার টন মসুর ডাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

সব পণ্যের দাম যখন বাড়ছে তখন থেমে নেই ডিমের বাজারও। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে দফায় দফায় বেড়েছে ডিমের দাম। রাজধানীর খিলক্ষেত, ভাটারা, সোলমাইদ, নতুন বাজার, বাড্ডাসহ বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহ ব্যবধানে ডজনপ্রতি দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও ডিমের ডজন ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। আর ৪৫ টাকা হালি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে। সপ্তাহের ব্যবধানে লাল ডিম ডজনপ্রতি ১১০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৩০ টাকা। হাঁসের ডিম ১৩০ টাকা থেকে ১৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। দেশি মুরগির ডিমে যেন আগুন। ১৭০ টাকা ডজন থেকে এখন ১৯০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

ছোলমাইদ এলাকার বাসিন্দা শরীফ শেখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাছ-মাংসের দাম বেড়ে গেছে। এরপর আবার ডিমের দামও বাড়ল। এক হালি ডিম কিনেছি ৪৫ টাকায়। অল্প টাকা বেতনে ঢাকায় থাকাই এখন দায় হয়ে গেছে। উৎপাদন কিংবা সরবরাহে ব্যাঘাত না ঘটলেও তবুও ডিমের দাম বাড়ায় হতাশ নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কম চাহিদার মৌসুমে এতদিন তারা ডিমে যে পরিমাণ লোকসান গুনেছেন, এখন দাম বাড়িয়ে তার কিছুটা হলেও সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন। এদিকে কোরবানির ঈদের অজুহাতে মসলার বাজারেও অস্থিরতা দেখা গেছে।


আরও খবর

এলপিজির দাম আরও বাড়ল

বৃহস্পতিবার ০২ নভেম্বর 2০২3