Logo
শিরোনাম

দিন দিন বাড়ছে শিশুদের কিডনি রোগ

প্রকাশিত:শনিবার ১৪ জানুয়ারী ২০২৩ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ৬৩০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

ডা. আবু সাঈদ শিমুল

শিশুদের কিডনির সমস্যা হলে সেই শিশুর তো ক্ষতি হয়ই, সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারেই নেমে আসে উদ্বেগ আর হতাশা। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো, শিশুদের মধ্যে কিডনি রোগ দিন দিন বাড়ছেই। কিন্তু দেরিতে রোগ নির্ণয়ের ফলে অনেক বাচ্চাই এমন সময় চিকিৎসকের কাছে যায়, যখন আর করার কিছু থাকে না। শিশুদের কিডনি রোগের একটা অংশ জন্মগত। এসব ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় মায়েদের সচেতন হতে হবে। আবার জন্মের পরও বিভিন্ন রোগে কিডনি বিকল হতে পারে। এই ক্ষেত্রেও সামান্য সাবধান হলে শত শত শিশুকে বাঁচানো সম্ভব।

শিশুদের কিডনি রোগের কারণ: বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির কারণ রয়েছে। যেমন: একিউট কিডনি ইনজুরি বা হঠাৎ কিডনি বিকল। সাধারণত বাংলাদেশে যেই কারণে এই কিডনি ইনজুরি হয় সেগুলো হলো ডায়রিয়া, বমি, অপরিচ্ছন্নতা, মা শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ানো। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, হারবাল ওষুধ চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র ছাড়া ব্যবহার করা। অনেক সময় বিনা কারণে এক্স-রে করলে এক্স-রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের জন্য কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হলো ডায়রিয়া ও বমি। এর কারণেও কিডনি বিকল হতে পারে। শিশু যদি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা সিকেডিতে আক্রান্ত হয়, কিডনি পুরোপুরি অক্ষম হয়, ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, তবে চিন্তার কিছু নেই। দেশেই এখন কিডনি রোগের সুচিকিৎসা সম্ভব। এ ছাড়া নিয়মিত ফলোআপ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব।

শিশুর কিডনি রোগের লক্ষণ: ঘন ঘন প্রস্রাব করা, প্রস্রাবে ইনফেকশন হওয়া, ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব করা, বিছানায় প্রস্রাব করা (৬ বছরের অধিক বয়সে), প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রস্রাবের সময় তলপেট/কোমর ব্যথা করা, শরীরে পানি আসা/ফুলে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, কিডনিতে পানি জমা হওয়া, কিডনি ছোট-বড় হওয়া, উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়া, কিডনিতে জন্মগত ত্রুটি থাকা।  এসব লক্ষণ দেখা গেলে, পরিবারের কারও কিডনি রোগ থাকলে, শিশু সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করলে, জন্মের পর শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হলে দেরি না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

রোগ নির্ণয়: শিশুদের কিডনি রোগ শনাক্ত এবং যথাযথ চিকিৎসার জন্য একজন দক্ষ শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ বা পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ প্রয়োজন। অভিজ্ঞ পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্ত, প্রস্রাব এবং আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

চিকিৎসা: কিডনি রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে তা কোন পর্যায়ে আছে বা কী কারণে হয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্মগত কিডনি রোগের চিকিৎসায় কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন হয়। তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশুই বারবার প্রস্রাবের সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। তাই তাদের ক্ষেত্রে লম্বা সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়।

ডায়রিয়াজনিত কারণে কিডনি সমস্যা হলে, প্রয়োজনমতো পানিশূন্যতা এবং রক্তের লবণের তারতম্য ঠিক করা হয়। ক্রনিক কিডনি ফেইলিউর প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ওষুধের সাহায্যে এবং জীবনযাত্রা পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ করে বেশ উপকার পাওয়া যায়। তবে শেষ পর্যায়ে ধরা পড়লে ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়।

শিশুর জ্বর, ডায়রিয়া ও কিডনি রোগ: জ্বর হলে শিশুরা খেতে চায় না । এ সময় তারা বুকের দুধ, পানি কিংবা তরলও কম খায় । এ বিষয়টিকে অনেক মা-বাবা গুরুত্ব দেন না। এর ফলে তাৎক্ষণিক কিডনি অকেজো বা একিউট কিডনি ইনজুরি হয়ে যেতে পারে। তাই শিশুর যেকোনো অসুস্থতায় প্রচুর তরল খাওয়াতে হবে। পানি বা বুকের দুধ খাওয়াতে পারলে খুব ভালো হয়, কিন্তু তা খাওয়ানো না গেলে ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের বাসায় তৈরি জুস, শরবত ইত্যাদি খাওয়াতে উচিত। ডায়রিয়ায় সঠিকভাবে স্যালাইন বানাতে হবে। আধা লিটার পানিতে এক প্যাকেট ওরস্যালাইন- এটাই হলো খাওয়ার স্যালাইন বানানোর একমাত্র পদ্ধতি। শিশুর বয়স কম কিংবা অন্য যুক্তিতে স্যালাইন বা পানির পরিমাণ কমবেশি করা যাবে না।

শিশুদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয়: শিশুদের কৃত্রিম জুস ও প্রিজারভেটিভ মিশ্রিত ও টিনজাত খাবার দেয়া যাবে না। কারণ এতে কিডনি বিকল হতে পারে।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়েট্রিকসের গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো শিশু তিন বছর বয়সের পর যখনই ডাক্তারের কাছে যাবে, তখনই প্রেশার মাপাবে। শিশুদের প্রেশার বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ কিন্তু উচ্চরক্তচাপ। তাই শিশুদের প্রেশার বা রক্তচাপ বেশি হলেই কিডনি সুস্থ আছে কি না পরীক্ষা করে তা দেখতে হবে। শিশুর প্রস্রাবের সঙ্গে ব্যথাযুক্ত বা ব্যথাহীনভাবে রক্ত গেলে কিংবা এলবুমিন নামক প্রোটিন গেলে সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। মাতৃগর্ভে থাকার সময় মায়ের যে আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়, তা দিয়েই প্রাথমিকভাবে শিশুর কিডনির জন্মগত রোগ আছে কি না, তা দেখা যায়। তাই আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার সময় চিকিৎসককে শিশুর কিডনি পরীক্ষার কথাও জানান। এ জন্য জন্মগত ত্রুটি নির্ণয় করতে পারে এমন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ দিয়েই পরীক্ষা করানো উচিত। শিশুর জন্মের পরেই লক্ষ করুন, ছেলেশিশুর পুরুষাঙ্গ স্বাভাবিক আছে কি না, শিশুর মূত্রনালির বহির্মুখটি সঠিক স্থলে আছে কি না, ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে তার অণ্ডকোষ দুটি স্বাভাবিক অবস্থানে আছে কি না ইত্যাদি। না থাকলে বা কোনো সন্দেহ হলে অবশ্যই ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করান।

শিশু যাতে পর্যাপ্ত পানি পান করে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করুন। যেমন- স্কুলে টিফিনের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ পানি দিন। কোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি রাখুন। এ ছাড়া যেকোনো জ্বর কিংবা ডায়রিয়ায় শিশু যেন পর্যাপ্ত পানি খায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।  শিশুদের শরীরে খোসপাঁচড়া ও গলাব্যথা হলে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া উচিত। কারণ এ দুটি রোগ থেকে কিডনি অকার্যকর হতে পারে, যা প্রাথমিক পর্যায়ে নিরাময় ও জটিলতা প্রতিরোধ সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ, বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা। শিশুর প্রস্রাব কমে গেলে বা শরীর ফুলে গেলে দ্রুত শিশু কিডনি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।

ওপরের নিয়মগুলো মেনে চললে এবং সময়মতো চিকিৎসকের কাছে গেলে কিডনি রোগ থেকে আমাদের শিশুরা অনেকটা রক্ষা পাবে।

লেখক: শিশু বিশেষজ্ঞ, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

নিউজ ট্যাগ: কিডনি রোগ

আরও খবর