Logo
শিরোনাম

ঝুঁকিতে হাইড্রোজেন শিল্প

প্রকাশিত:সোমবার ১৩ জুন ২০২২ | হালনাগাদ:বুধবার ১৫ নভেম্বর ২০২৩ | ১১৬৫জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

হুমকির মুখে পড়েছে দেশের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড শিল্প। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর সিঙ্গাপুর বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে পাঠানো এক নোটিশে সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ এ কথা জানায়। ফলে ১৪টি দেশে এই কেমিক্যালে রফতানি এখন অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যদিও বিপত্তি এড়িয়ে কলম্বো বন্দর ব্যবহার করা যাবে এমন আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে সেটি দ্রুত সমাধান করতে না পারলে বিপাকে পড়তে যাচ্ছে দেশের ৬টি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান। অথচ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০৭ কোটি টাকার সমান। এদিকে জাহাজে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডভর্তি কনটেইনার না নেয়ার কারণে বিপত্তিতে পড়েছে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো। বর্তমানে ডিপোতে রফতানির অপেক্ষায় থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কনটেইনারগুলো সরানোও সম্ভব হচ্ছে না। আবার শিপেও দেয়া যাচ্ছে না। বন্ডের কারণে এসব কনটেইনার নিরাপদ জায়গায় সরানো নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল শিপিং লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ জানান, বিভিন্ন এজেন্টের কাছে শিপ ওনাররা বার্তা পাঠাচ্ছেন জাহাজে বাংলাদেশ থেকে কনটেইনার বুকিংয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে। শনিবার (১১ জুন) থেকে অধিকাংশ এজেন্ট রফতানির জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার বুকিং নেয়া বন্ধ রেখেছে। এর বেশ প্রভাব পড়বে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণে। দেশের বন্দর সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় আইএমডিজি কোড না মানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন বিপত্তি যোগ হবে দেশের রফতানি পণ্য পরিবহনে।

বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কাইয়ূম খান বলেন, সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারলে চট্টগ্রাম বন্দর, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হবে আন্তর্জাতিক বাজারে। দেশের আমদানি-রফতানি অবকাঠামো বিশ্বমানের সেটি প্রমাণ করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে কনটেইনার বিস্ফোরণের কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বন্দরে রফতানি পণ্য পরিবহন নিয়ে কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে বাংলাদেশ এমন আশঙ্কায় ছিলেন আমদানি-রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের দেয়া তথ্যমতে, সিঙ্গাপুর বন্দরের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়বে বাংলাদেশের রফতানি খাত। কারণ, বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের প্রায় অর্ধেকই রফতানি হয় সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম থেকে ছোট জাহাজে করে পণ্যভর্তি কনটেইনার নিয়ে রাখা হয় সিঙ্গাপুর বন্দরে। সেখান থেকে বড় জাহাজে তুলে আমদানিকারক দেশগুলোতে পাঠানো হয় পণ্য। সিঙ্গাপুর ছাড়াও শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর দিয়ে এভাবে কনটেইনারে রফতানির পণ্য পরিবহন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনারে রফতানি পণ্য পরিবহন কার্যক্রম কঠোর সতর্কতার আওতায় আসতে পারে অন্যান্য বন্দর থেকেও। বিপদের আশঙ্কায় এরই মধ্যে বিভিন্ন শিপিং লাইন্সের পাশাপাশি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো নতুন করে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডভর্তি কনটেইনার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নিয়ে বিধিনিষেধ শীর্ষক সিঙ্গাপুর বন্দরের নোটিশে বলা হয়, ৪ জুন রাতে বাংলাদেশে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর সিঙ্গাপুর বন্দরে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কনটেইনার খালাস হয়। নোটিশে বলা হয়, সিঙ্গাপুর বন্দরে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কতটি কনটেইনার মজুদ করা যাবে, সেটির সীমা রয়েছে। বর্তমানে বন্দরটিতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালানের মজুদ বেড়ে গেছে। সিঙ্গাপুর বন্দরকে নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখতে নতুন করে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান গ্রহণ না করার পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

জানা গেছে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দেশের টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এ পণ্য একসময় বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে এটি রফতানি হচ্ছে। ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন, প্রবল শক্তিমাত্রার বিস্ফোরণে রূপ নেয়ার কারণ হিসেবে কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই এই কেমিক্যালটিকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানির বৈশ্বিক অবস্থানে ১৭তম বাংলাদেশ। দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান নিজেদের উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দেশের বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করে থাকে। বর্তমানে দেশে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এসএম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড, ইনফেনিয়া কেমিক্যাল ও চট্টগ্রামের আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। এর মধ্যে আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ও বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকানা একই প্রতিষ্ঠানের। দেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড (H2O2) মোট চাহিদার বড় অংশই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জোগান দেয়। বিস্ফোরণের নেতিবাচক প্রভাবে এখন পুরোটাই দখলে যাবে বিদেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে। পাকিস্তান, নেপালসহ বেশ কিছু বাজারে বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ক্রেতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিস্ফোরণের সঠিক কারণ চিহ্নিত না হলে কেউই আমাদের দেশের উৎপাদিত কেমিক্যালটি ক্রয় করবে না বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। কেমিক্যালের কনটেইনার থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের মতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা বিশ্বে প্রথম, ক্রেতাদের মাঝে তৈরি হওয়া আস্থা সংকট কাটতেও বেশ সময় লাগবে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০৭ কোটি টাকার সমান। এই খাতের রফতানি আয় দ্রুত বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যে পরিমাণ রফতানি হয়েছে, তা আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ( H2O2) রফতানি আয় বেড়েছে তিন গুণ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই কেমিক্যাল রফতানিতে সরকার ভর্তুকিও দেয় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানি করেছে ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে। মোট ১৪টি দেশে রাসায়নিকটি রফতানি হয়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বাজারের পুরোটাই আমরা হারাব। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে রফতানিতে এই কেমিক্যাল রফতানির প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক ছিল। করোনাকালে স্যানিটাইজারসহ বিভিন্নভাবে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ব্যবহার বাড়ার কারণে যে বৈশ্বিক চাহিদার জোগান দেয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পরে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণার কারণে তার পুরোটাই ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এই খাতের বিনিয়োগকারীরা। সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নিয়ে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ হওয়ার কারণে এমন বার্তা যাচ্ছে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে। যদিও বিপত্তি এড়িয়ে কলম্বো বন্দর ব্যবহার করা যাবে এমন আশা রয়েছে। জানা গেছে, দেশের ছয়টি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড শিল্প উৎপাদিত কেমিক্যালের ক্যাপ তৈরি করা হয় হাই ডেনসিটি পলি ইথিলিন (HDPE) দিয়ে। সেখানে গোর প্যাকিং ভ্যান্ট-উ-১৭ ব্যবহার করা হয়। এটি জার্মানি থেকে আমদানি করে ব্যবহার করেন শিল্পমালিকরা। যার প্যাকেজিং (UN)-২০১৪, ক্লাস ৫.১(৮), প্যাকিং গ্রুপ অনুসারে তৈরিকৃত।

জাহাজে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার না নেয়ার কারণে বিপত্তিতে পড়েছে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো। বর্তমানে ডিপোতে রফতানির অপেক্ষায় থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কনটেইনারগুলো সরানোও সম্ভব হচ্ছে না। আবার জাহাজেও দেয়া যাচ্ছে না। বন্ডের কারণে এসব কনটেইনার নিরাপদ জায়গায় সরানো নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মেরিন খাতের ব্যবসায়ী মাস্টার মেরিনার আবুল ফয়েজ মনে করেন, বিপজ্জনক দ্রব্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কনটেইনার ডিপোগুলো আইএমডিজি (ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস)কোড মানছে না এমন বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন নতুন বিপত্তি যোগ হবে দেশের আমদানি-রফতানি পণ্যে। বিষয়টি দেশের বন্দরের সুনামের জন্যও খারাপ হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, দেশের প্রত্যেক শিল্প কারখানায় কোন না কোন কাজে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহার হচ্ছে। এটি যেমন বিদেশ থেকে আমদানি হয়, তেমনি দেশ থেকে রফতানিও হয়। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রফতানি করে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। গত তিন বছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে ৪০৪ কোটি টাকা আয় করেছে।

উল্লেখ্য, গত ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে একটি কনটেইনারে লাগা আগুন ভয়ানক বিস্ফোরণে রূপ নেয়। গার্মেন্টস পণ্যের একটি কনটেইনারে আগুন লাগার পর সেখানে রাসায়নিকভর্তি (H2O2) কনটেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ২০০ জন চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি কারণ অনুসন্ধানে একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছে।


আরও খবর

আতশবাজির আলোতে ঝলমলে রাজধানী

রবিবার ০১ জানুয়ারী ২০২৩

রসগোল্লার জন্মদিন আজ

মঙ্গলবার ১৫ নভেম্বর ২০২২