Logo
শিরোনাম

তাঁত পল্লীতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা

প্রকাশিত:সোমবার ২৫ এপ্রিল ২০২২ | হালনাগাদ:শনিবার ২৫ নভেম্বর ২০২৩ | ২২১০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

করোনা মহামারীর কারণে টানা দুই বছর স্থবির হয়ে পড়ে সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প। এ সময় সব তাঁত বন্ধ রাখা হয়। বেকার হয়ে পড়েছেন তাঁত শ্রমিকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁতসংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ। করোনার প্রকোপ এখন কমে এলেও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তাঁত শিল্প মালিক ও শ্রমিকরা। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঈদ সামনে রেখে জেলার তাঁতসমৃদ্ধ শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ সদরের এনায়েতপুর, চৌহালী, বেলকুচি ও উল্লাপাড়াসহ জেলাজুড়ে এখন দিনরাত কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা তাঁতপণ্য উৎপাদনে ব্যস্ত। তাঁতের খটখট শব্দ ও কারখানা মালিক-শ্রমিকদের কোলাহলে  সরব হয়ে উঠেছে জেলার তাঁত পল্লী। পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নারীরাও নলিতে সুতা ভরা, সুতাপারি করা, মাড় দেয়া ও রঙতুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননে সহযোগিতা করছেন।

করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় ঈদে প্রায় দুই হাজার  কোটি টাকার বাজার ধরতে তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। বিপর্যয়ের অতীত ভুলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। তাদের সে চেষ্টায় বাধা সৃষ্টি করেছে সুতা ও রঙের দাম বৃদ্ধি এবং ব্যবসায় কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায়। দুই বছরে সুতা ও রঙের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। করোনার পর ব্যবসায়িক মন্দা কেটে যাবে—এমন ধারণা থাকলেও মূলত ব্যবসা সেই প্রকারে নেই। জেলার বিখ্যাত কাপড়ের হাট শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, সোহাগপুর ও সদরের নিউমার্কেটে কাঙ্ক্ষিত বেচাকেনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বেলকুচির বৈধ্যনাথ রায় বলেন, করোনার মহাবিপর্যয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেলার তাঁত শিল্প। অনেকে পুঁজি সংকটে রয়েছে। তার পরও এ বছর অনেক আশা নিয়ে উৎপাদন শুরু করেছি। ব্যবসা হবে না। তাঁতের পণ্য উৎপাদনের প্রধান উপকরণ সুতা ও রঙের অস্বাভবিক দাম বেড়েছে। দুই বছর আগে ৫০ ও ৫৪ কাউন্টের সুতা (৫০ কেজি) ১২ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন সেই সুতা ২৬ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বাইন্ডার রঙ ১৪০ থেকে ২৮০, লাল রঙ ৪৮০ থেকে ৬০০, ব্লু রঙ ৩৫০ থেকে ৬৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সুতা, রঙসহ সব ধরনের তাঁত উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়লেও কাপড়ের দাম বাড়েনি। তার পরও হাটে পাইকার তেমন নেই। সদর উপজেলার বাঐতারা গ্রামের তাঁত মালিক আবদুল হাসেম বলেন, তার আটটি তাঁতে সপ্তাহে ১৬০ পিচ কাপড় উৎপাদন হয়। আগে ঢাকা ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে কাপড় নিয়ে যেত কিন্তু এ বছর পাইকার আসেনি। হাটেও তেমন ক্রেতা নেই।

সিরাজগঞ্জ তাঁতি সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, জেলার প্রায় নয় লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। করোনার সময় জেলার সব তাঁত বন্ধ ছিল। অনেকে তাঁত বিক্রি করে দিয়েছেন, অনেকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন করোনার প্রভাব কাটিয়ে ঈদ সামনে রেখে তাঁতিরা উৎপাদনে গেলেও সুতা, রঙসহ তাঁত শিল্পের সব উপকরণের দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে জেলার লাখ লাখ তাঁতি। করোনা-পরবর্তী যেমনটা আশা করা গিয়েছিল ব্যবসা তেমন হবে না। এর পরও সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে জেলার তাঁত শিল্প।

এদিকে  করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ঈদ সামনে রেখে আবার কর্মমুখর হয়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত শ্রমিকরা। নিপুণ হাতে তৈরি করছেন ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ পাথরাইল, চন্ডী, বল্লা, রামপুর, নলশোধা, বাজিতপুর, করটিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতিদের ফুরসত নেই। অল্পসংখ্যক শ্রমিক ঈদ মার্কেটের শাড়ির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। করোনার পর এবার সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হতাশার মধ্যে রয়েছেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। সুতার দামের কারণে বেড়েছে শাড়ির দামও। এতে করে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে শাড়ি।

সরেজমিন তাঁতপল্লীগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল কর্মযজ্ঞে নির্ঘুম সময় কাটছে তাঁত শ্রমিকদের। তাঁত শ্রমিকরা কেউ চরকায় সুতা কাটছেন, কেউ সুতা টানা দিচ্ছেন, কেউ কেউ শানায় সুতা ভরছেন, কেউ মাকু টেনে শাড়ি বোনাচ্ছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাপড় বুনতে সহযোগিতা করছেন। টাঙ্গাইলের শাড়ি বিক্রেতা ও কারিগররা বলেন, করোনার মধ্যে আমাদের ব্যবসা বন্ধ ছিল। ঈদ সামনে রেখে ভালোই শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। সুতার দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে আমাদের খরচ ও শাড়ির দামও বেড়েছে।

টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, করোনার এ সময়ে কাজের ঘাটতি হয়েছে। যেসব শ্রমিক পেশা ছেড়ে চলে গেছে, তাদের ফিরিয়ে আনা কোনোভাবে সম্ভব হচ্ছে না। এ বছর ঈদ সামনে রেখে আমাদের বড় একটি আশা রয়েছে। সুতার দাম বেশি থাকায় একটু সমস্যা হচ্ছে শাড়িগুলো বিক্রি করতে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে তাঁতিদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ঠিক মতো শাড়ি তৈরি করতে পারছিলেন না। যারা এ পেশা থেকে সরে গিয়েছিলেন তাদের আবার ফিরেয়ে আনতে চেষ্টা করছি। এছাড়া তাঁত বোর্ড থেকে তাঁত মালিকদের ঋণ সুবিধা দেয়া হবে।

পর্যটন জেলাখ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা মণিপুরী তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় মণিপুরী তাঁতের শাড়ি, থ্রিপিচ, চাদর, গামছা, পাঞ্জাবিসহ তাঁতে বোনা পোশাক। দুই বছর করোনার থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ ক্ষুদ্র শিল্প। করোনার প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন মণিপুরী তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তাই ঈদ সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। সম্প্রতি কমলগঞ্জের মণিপুরী পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁত বুনতে ব্যস্ত রয়েছেন তাঁতিরা। বড়দের পাশাপাশি স্কুল-কলেজপড়ুয়া অনেকে যুক্ত হয়েছেন এ কাজে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, মণিপুরী তাঁত শিল্পের প্রসারে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করবেন।


আরও খবর