বারবার চিঠি দিয়ে, বৈঠক, অভিযান, ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করেও বকেয়া গ্যাস বিল আদায়ে সুবিধা করতে পারছে না সরকার। গত মার্চের মধ্যে সব বকেয়া গ্যাস বিল আদায় করতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। গত ডিসেম্বরে দেওয়া সে নির্দেশের সময় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির অধীনে বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। মার্চ শেষে এখন সেই অনাদায়ি পাওনা এখনো ৯ হাজার ৫০ কোটি টাকার বেশি। তিন মাসে বকেয়া বিলের পরিমাণ আড়াই শ কোটি টাকাও কমাতে পারেনি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বকেয়া গ্যাস বিল সহনশীল মাত্রায় না কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চারটি বড় কারণ শনাক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এক. কয়েকটি শিল্প গ্রুপের সঙ্গে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাসের মামলা। মামলার কারণে প্রায় ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা আদায় করতে পারছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকার মধ্যে এভারেস্ট পাওয়ার এবং ইউনাইটেড পাওয়ারের কাছেই পাওনা রয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি। দুই. দেশের কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ এবং কয়েক জন রাজনীতিকের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু কারখানা প্রায় প্রতি মাসেই বিলের কিছু অর্থ পরিশোধ করলেও বকেয়ার পরিমাণ ২০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে স্থির রাখছে। এ বকেয়া তারা পরিশোধ করছেন না। এমনকি অর্থ আদায় করতে গেলে অনেক সময় তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলাও করছে স্থানীয়রা।
বর্তমানে শুধু তিতাস গ্যাসেরই বেসরকারি খাত থেকে প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তিন. সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানও বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ বিল বাকি রাখছে। গত জানুয়ারি শেষে শুধু তিতাসের সরকারি খাত থাকে পাওনা ছিল ৭৪৩ কোটি টাকা। চার. বেসরকারি খাতে বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া এবং অবৈধ সংযোগের পেছনে তিতাসের কয়েক জন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিবন্ধিত ঠিকাদারদের একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। অপকৌশলে অর্থ আয়ের জন্য তারা নানা কৌশলে বিল ফাঁকি ও গ্যাস চুরি করছে। এমনকি বিল না দেওয়া বা গ্যাস চুরির কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়া সংযোগেও ফের সংযোগ দিচ্ছে।
দেশের সিংহ ভাগ গ্যাস ব্যবহার করেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গ্রাহকরা। সংখ্যার বিচারেও বাকি সবগুলোর চেয়ে এর গ্রাহকসংখ্যা বেশি। এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, বকেয়া বিল আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিছু বাধা থাকলেও সেগুলো সরিয়ে বিল আদায় করা হচ্ছে। মামলার কারণে বড় পরিমাণ বিল আদায় করতে পারছি না। আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি দ্রুত সুরাহা হবে বলে আশা করছি।
সূত্র জানায়, তিতাস মাসে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের গ্যাস বিক্রি করে। গত জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করে ১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বিল আদায় করে। অর্থাৎ মাসিক বিক্রির পরিমাণের টাকাই আদায় করতে পারেনি। ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা আদায় করে যা বিক্রির পরিমাণের চেয়ে অল্প কিছু বেশি। তবে মার্চে বকেয়া আদায়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এ মাসে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার বিল আদায় করেছে। অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা বকেয়া কমেছে। তিন মাসে মোট বকেয়া কমার পরিমাণও এটি।
এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালক (অর্থ) এ কে এম বেনজামিন রিয়াজী বলেন, বকেয়া আদায়ের ওপর খুবই জোর দেওয়া হয়েছে। গত মাস পর্যন্ত বেশ ভালো পরিমাণ বকেয়া আদায় করা হয়েছে।
এদিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে গ্যাস খাতের সংস্থা-কোম্পানিগুলোর অনাদায়ি পাওনা সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় জানানো হয়, ডিসেম্বর শেষে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির অনাদায়ি পাওনা ছিল ৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। জানুয়ারি শেষে তা মাত্র ৪ কোটি কমে হয় ৯ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ২০০ কোটি টাকার মতো বকেয়া আদায় হয়েছে। গত মার্চ শেষে এটি এখনো ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ঐ সভায় উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি শেষে তিতাস গ্যাসের বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৮১৫ কোটি টাকা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৮০৫ কোটি টাকা, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের ৭৩৯ কোটি টাকা, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির ১৭৬ কোটি টাকা, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ৯৯ কোটি টাকা বকেয়া ছিল। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছয় কোম্পানি মিলে ২০০ কোটি টাকার মতো বকেয়া আদায় করেছে।