সেন্ট যোসেফ
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৬ বছর বয়সী হাবিবা সুলতানা। সে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর
শ্যামলীর শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পাঁচ দিনের জ্বরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায়
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সাপোর্টে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তবে এই হাসপাতালে
আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় সাধারণ ওয়ার্ডে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। হাবিবার
বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা। গতকাল রোববার রাজধানীর ৫ থেকে ৬টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে
খোঁজ নিলেও আইসিইউ শয্যা মেলাতে পারেননি তিনি।
একই অবস্থা
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা আয়েশা বেগমের শিশুসন্তান সৈকতের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে
তিন দিন বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিল সে। চার দিনের মাথায় সংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি হয় শিশু
হাসপাতালে। আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় হাবিবার মতো তাকেও অপেক্ষায় থাকতে বলছে হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, অক্টোবরের শুরু থেকেই আইসিইউ সংকট বেশি দেখা দিয়েছে। শয্যা না
থাকায় অন্য হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর ভয়াল
পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এমন অবস্থা শুধু শিশু হাসপাতালে নয়, রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালেও।
দেশে করোনার সংক্রমণ যখন উদ্বেগজনক ছিল, সেই সময় যেমন আইসিইউ শয্যা নিয়ে হাহাকার ছিল,
তেমন চিত্র আবার ফিরে এসেছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ফাঁকা না পেয়ে রোগী নিয়ে কঠিন
পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্বজনদের। অথচ এবারের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ৩৫ শতাংশই
শিশু। যাদের একটি বড় অংশের চিকিৎসাধীন অবস্থায় শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু
হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইসিইউ সংকট আগেও
ছিল। ডেঙ্গুর প্রকোপে আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। আইসিইউ শয্যা প্রয়োজন এমন ৩২ জন রোগী
অপেক্ষমাণ। এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশ কিছু অঙ্গে প্রভাব ফেলায় দ্রুত সংকটাপন্ন অবস্থা
তৈরি হচ্ছে। এমনকি এ সেবা দিতে কিছুটা বিলম্ব হলে রোগীদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ারও আশঙ্কা
তৈরি হচ্ছে। ডেঙ্গু সংকটে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে অন্যসব রোগের চিকিৎসাও।
রাজধানীতে ডেঙ্গু
আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এখানে আড়াই হাজার ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এই হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউতে এখন রোগী
ভর্তি রয়েছেন। তার মধ্যে জটিলতা নিয়ে একজন ডেঙ্গু রোগী আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। রাজধানীর
একাধিক হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম দেখা দেওয়ার পর এ ধরনের
অনেক রোগীকেই বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে। লিখিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি করিয়ে প্রয়োজনীয়
চিকিৎসাসেবা দেওয়ার। ঢামেক হাসপাতালে ৮০টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও বেশিরভাগই অন্য রোগে
আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের দখলে রয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি
পর্যায়ে স্কয়ার, ইউনাইটেড কিংবা এভারকেয়ারের মতো উন্নতমানের হাসপাতালে ব্যয়বহুল নিবিড়
পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রেখে রোগীর চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের
নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, হাসপাতালে মোট শয্যার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকার কথা থাকলেও
দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে তা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ৩ হাজার
বেডের অনুপাতে ৩০০টি আইসিইউ বেড থাকার কথা। কিন্তু আছে মাত্র ৮০টি।
এ পরিস্থিতিতে
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, যে ৩১ হাজার রোগী চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন,
এর ১০ শতাংশ রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিলে তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় আইসিইউ কিংবা পিআইসিইউ
নেই। ফলে আগামীতে মৃত্যুঝুঁকি আরও বাড়বে।
জনস্বাস্থ্যবিদ
ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, এবার কয়েক ধরনের জ্বর একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশি দেখা
দিচ্ছে ডেঙ্গু, করোনা ও সাধারণ সর্দি জ্বর। এসব ভাইরাসজনিত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই
দুই থেকে তিন দিন বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই অপেক্ষার কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে
জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আইসিইউ
ও পিআইসিইউ বাড়ানো জরুরি। তিনি আরও বলেন, শক সিনড্রোমে তাঁদের শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য
বিঘ্নিত হয় এবং রক্তের প্লাটিলেট কমতে থাকে। ফলে তাঁদের দ্রুত নিবিড় চিকিৎসা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
তথ্য বলছে, এবার ডেঙ্গুতে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের ৪৮ শতাংশেরই শক সিনড্রোম ছিল। এর
একটি বড় অংশ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু
রোগে আক্রান্ত হয়ে আরও ১ হাজার ৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি মাসের ২৩ দিনে
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার রোগী। এ সময়ে ৫৮
জনের মৃত্যু হয়েছে। সবমিলিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা
বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৬৩ জনে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহামেদুল কবীর বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে
ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। আমাদের প্রস্তুতি হিসেবে রাজধানীর মহাখালী ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালকে
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৯০ শয্যা ও ১৭টি
আইসিইউ রোগীর জন্য প্রস্তুত, প্রয়োজনে আরও ৫০০ শয্যায় ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হবে।