রাজধানী ঢাকার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ পায়ে হেঁটেই চলাচল করেন। কিন্তু পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য নগরীতে নেই পর্যাপ্ত ও নিরাপদ ফুটপাত। উঁচু-নিচু, ভাঙা, যখন-তখন ফুটপাত খোঁড়াখুঁড়ি, হকারদের দাপট, মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যাওয়ার কারণে ফুটপাত ধরে চলাচলকারী নগরবাসীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ছাড়া, বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকায় বাইসাইকেলের আরোহী বাড়লেও বিকল্প সাইকেল লেন গড়ার উদ্যোগ বরাবরই সরকারি পরিকল্পনায় উপেক্ষিতই থাকছে। এক হিসাবে দেখা যায়, বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। তারপরও দেশে পরিবেশ না থাকায় বাইসাইকেল চালাতে পারছে না নগরবাসী। যারা চালাচ্ছেন তারাও ঝুঁকি নিয়ে চালাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সংকটের এই সময়ে হাঁটার পরিবেশ নিশ্চিত করলে অনেক সাশ্রয় হতো। এ ছাড়া বাইসাইকেল চালানোর পরিবেশ থাকলেও ব্যাপকভাবে জ্বালানি সাশ্রয় হতো। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেট্রোরেল মোট গণপরিবহণের চাহিদার মাত্র ১৭ শতাংশ মেটাবে। ফ্লাইওভারও ব্যবহার করে নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ চলা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও শুধু পরিবহন চলাচলের কাজে ব্যবহার করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর ফুটপাতের উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে সামান্য কিছু টাকা ব্যয় করলেই ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে হাঁটার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া নগরীর সড়কগুলোর দুই পাশের প্রায় অর্ধেকই অবৈধ গাড়ি পার্কিং করে দখল করে রাখা হয়। এই অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে দুই পাশে বাইসাইকেল লেন করে দিলেই বাইসাইকেল চালকদের জন্য যেমন উপকার হত তেমনি পরিবেশের জন্যও ভালো হতো। দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা শহরে ফুটপাত আছে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি। এই ফুটপাতের বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, হাঁটার অনুপযোগী এবং দখলদারদের দখলে। ফুটপাতগুলো সংস্কার করা হয় না বললেই চলে। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় কিন্তু অভিযান শেষে সিটি করপোরেশনের লোকজন চলে গেলেই আবার দখল হয়ে যায়।
হাঁটতে চাইলেও পরিবেশ ও নিরাপত্তা নেই: দুই কোটি মানুষের ঢাকা শহরে ৬০ ভাগ অর্থাৎ ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ হেঁটে চলতে চাইলেও তাদের নিরাপত্তা নেই এই শহরে। গতবছর প্রথমবারের মতো পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘পথচারী প্রবিধান নীতিমালা-২০২১’ এর খসড়া হলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, বর্তমানে জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। তাই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নগরে হেঁটে যাতায়াতের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা আবশ্যক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাঁটা ও সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের পরিকল্পনায় হাঁটা ও সাইকেলকে প্রাধান্য দেয়।
সাইক্লিস্টের সংখ্যা বাড়লেও সরকারি পরিকল্পনা নেই: বিশ্বজুড়ে বড় শহরগুলোতে বাইসাইকেল একটি জনপ্রিয় বাহন। ঢাকা শহরেও গণপরিবহনের অপ্রতুলতা ও নানা সীমাবদ্ধতায় নগরবাসী সাইকেলের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু তাদের অভিযোগ, ঢাকার রাস্তাঘাট সাইকেলবান্ধব নয়। বরং এই নগরীতে সাইকেল চালানো ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকির কারণ মূলত আলাদা সাইকেল লেন না থাকা। বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার-সিএনজি চালিত অটোরিকশা-মোটরসাইকেলের মতো বাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালানো কঠিন। সাইক্লিস্টরা জানান, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গাড়ি সড়কের উপর দাঁড় করিয়ে রাখার কারণে সেগুলোকে সাইড দিতে গিয়ে রাস্তার মাঝামাঝি চলে যেতে হয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।
ঢাকায় এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে এক কিলোমিটার সাইকেল প্রাধান্য অথবা সাইকেলবান্ধব একটা রুটও পাওয়া যাবে না দাবি করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যেগুলো আছে সেগুলোও খণ্ডিত। লেন মানে হলো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নির্বিঘ্নে যাতয়াত করা। তেমন কিছু নেই এই শহরে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে সাইকেলের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেটা বাংলাদেশে নেই উল্লেখ করে ইকবাল হাবিব বলেন, এটার জন্য পরিকল্পিত নগর চলাচল ব্যবস্থা যেমন দরকার সেটার কোনো উদ্যোগও আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।