উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে রোগীর পরিবারের সদস্যরা সারা রাত ধরে লাইন দিচ্ছেন অক্সিজেন কেনার জন্য - একেকটা সিলিন্ডারের দাম ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু সেটাও এখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অক্সিজেন সংকটে করোনাভাইরাস সংক্রমিত বহু রোগী প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে দৈনিক ২০ থেকে ২১ জন করোনা রোগী মারা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। দিল্লির অধিকাংশ হাসপাতালে একই চিত্র বর্তমান রিবাজ করছে। কোনোভাবেই দেশটি অক্সিজেন সংকটের ঘাটতি পুরণ করতে পারছে না।
কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, গত শুক্রবার রাতে ২০ জন গুরুতরভাবে অসুস্থ রোগী অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে মারা গেছেন। জয়পুর গোল্ডেন নামের ওই হাসপাতালের পরিচালকের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে যে, অক্সিজেনের অভাবে মারা যাওয়া অধিকাংশ রোগীই করোনা আক্রান্ত ছিলেন। প্রত্যেকেই অক্সিজেনের চাপ কমে যাওয়ার কারণে মারা যান। কারণ হাসপাতালের অক্সিজেনের মজুদ শেষ হয়ে যায়।
জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. দীপ বালুজা'র তথ্যমতে, হাসপাতালে বর্তমানে থাকা ২০০ রোগীর মধ্যে ৮০ জন অক্সিজেন সাপোর্টে এবং ৩৫ জন আইসিইউতে রয়েছেন।
হাসপাতালের পরিচালক হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, হাসপাতালের তরল অক্সিজেনের মজুদ শেষ হয়ে যায়। এরপর আমরা কেন্দ্রীয় গ্যাস পাইপ লাইনের সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংযোগ করে দিলেও, অক্সিজেনের চাপ কম থাকায় রোগীরা মারা যান। গতকাল শনিবার সকালে হাসপাতালটিতে মাত্র ৪৫ মিনিটের মতো অক্সিজেনের যোগান ছিল বলে দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. বালুজা বলেন, আমরা আবারও সংকটময় পরিস্থিতিতে। ২০০ জনের জীবন এখন ঝুঁকিতে। গত রাতে আমরা অধিকাংশ রোগীকে বাঁচাতে পারলেও আজ তা পারবো না। আমাদের অক্সিজেনের জরুরি মজুদও শেষ হয়ে গেছে।
গত শুক্রবার দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে অক্সিজেন মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২৫ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। একই চিত্র রবিবারও রয়েছে। এর আগে ২১শে এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরের একটি সরকারি কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে একসঙ্গে অন্তত ২২জন রোগী মারা যান।
ওই হাসপাতালের সামনে একটি ট্যাঙ্কার থেকে অক্সিজেন লিক হওয়ার জেরেই ঐ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। সেসময় আধা ঘণ্টার মত হাসপাতালের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ ছিল, যার ফলে ২২ জন রোগী প্রাণ হারান।
সেদিন সকালেও সেখানে অন্তত দেড়শো রোগী ভর্তি ছিলেন, যাদের হয় ভেন্টিলেটরে রেখে বা চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে চিকিৎসা চলছিল।অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর ঘটনা এমন সময়ে ঘটছে, যখন একদিনে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে টানা তৃতীয় দিনের মতো বিশ্বে রেকর্ড করেছে ভারত। বিগত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে তিন লাখ ৪৬ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
গত তিন দিনে দেশটিতে প্রায় দশ লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ভারতের কিছু কিছু এলাকার স্বাস্থ্য সেবা খাত তাদের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে হাসপাতালগুলো চরমভাবে অক্সিজেন সংকটে ভুগছে। অক্সিজেনের তীব্র আকাল এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও হৃদয়বিদারক করে তুলেছে- দেশের বহু হাসপাতালই অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকছে।
উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে রোগীর পরিবারের সদস্যরা সারা রাত ধরে লাইন দিচ্ছেন অক্সিজেন কেনার জন্য - একেকটা সিলিন্ডারের দাম ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু সেটাও এখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিবিসি-র সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন।
ওই উত্তরপ্রদেশেরই একজন সিনিয়ার সাংবাদিকের কথা জানা যাচ্ছে, যিনি একের পর এক টুইট করে আবেদন করছিলেন অক্সিজেনের চেয়ে - লিখছিলেন যে তার অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমে আসছে। তিনি শেষ পর্যন্ত অক্সিজেন পান নি - মৃত্যু হয়েছে তার।
তবে পূর্ব ভারতে অক্সিজেনের ঘাটতি এখনও হয়নি। যেহেতু মূলত ইস্পাত শিল্প কারখানাগুলো অবস্থিত - ওই কারখানাগুলোতেই শিল্পের জন্য অক্সিজেন মজুত থাকে - তারা চিকিৎসার জন্যও অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
তাই এই অঞ্চলে অক্সিজেনের থেকেই অক্সিজেন যেতে শুরু করেছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। তবে এই কাজটা আরও আগে শুরু করা উচিত ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরবরাহ বাড়াতে অতিরিক্ত ট্রেন মোতায়েন করেছে সরকার। সেই সঙ্গে সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিমান বাহিনীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
খবর পাওয়া যাচ্ছে, জার্মানি থেকেও অক্সিজেন পাঠানো হচ্ছে। অক্সিজেন সংকটের কারণে ভারত সরকারকে তিরস্কার করেছেন দিল্লি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সংকটের কারণে মহারাজা আগ্রাসেন হাসপাতাল দিল্লির হাইকোর্টে আবেদন করে।
শুনানির পর আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চান, 'এপ্রিলের ২১ তারিখে ৪৮০ মেট্রিকটন অক্সিজেন সরবরাহের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, সেটা কখন পাওয়া যাবে?' হাইকোর্ট বলেন, অক্সিজেন সংকটের জন্য যারা দায়ী, তাদের ছেড়ে দেয়া হবে না।
এর আগে আদালত সরকারকে বলেছিল ভিক্ষা করুন, ধার করুন, চুরি করুন- যা খুশি করুন কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহ করুন।