গ্রিক মিথলজির এক অন্যতম আকর্ষণ মেডুসা। সর্পকেশিনী ভয়ঙ্কর দানবী নামেই পরিচিত এই সুন্দরী যার মাথায় চুলের জায়গায় কিলবিল করতো সাপ, মানুষের মাথা হলেও শরীর ছিল সরীসৃপের ন্যায়‚ তবে সব থেকে ভয়ানক ছিল তাঁর চোখের দৃষ্টি‚ কেউ তাঁর চোখের দিকে তাকালেই মূহুর্তের মধ্যে পাথর হয়ে যেতো । তবে তার এই কুৎসিত চেহারার পেছনে রয়েছে দেবী অ্যাথেনার অভিশাপ । কথিত আছে, তিনি জন্ম থেকেই এমন ছিলেন না বরং অপূর্ব সুন্দরী এক নারী ছিলেন । মেডুসার জন্ম নিয়েও কিছুটা মতবিরোধ আছে । এমনকি রয়েছে মৃত্যু নিয়েও । গ্রীক বীর ডেমিগড (অর্ধেক মানব‚ অর্ধেক দেবতা) পার্সিউসের হাতে মৃত্যু হয় এই দানবীর । ধারনা করা হয়, মেডুসা হচ্ছে বিশাল দানব টাইফোয়িয়াস এবং অর্ধেক সাপ এবং অর্ধেক মানবী এচিডনার কন্যা । তাদের তিন কন্যা ছিলো । এই তিনজনকে একত্রে গর্গন বলা হতো, যার মানে ভয়ংকর নারী ! গর্গন বোনদের বাকি দুইজন হচ্ছে স্থেনো ও ইউরিয়েল। এই তিন বোনের মধ্যে মেডুসা ছাড়া বাকি দুইজন ছিল অমর। কেউ কেউ বলে থাকেন, মেডুসা প্রথমে গর্গন ছিলেন না, তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন । তার বাবা মা হচ্ছেন সমুদ্রের দেব-দেবী ফোরসিস এবং সিটো। অ্যাথেনার অভিশাপের পরে তিনি গর্গনে পরিণত হন । মিথলজি মানেই নানা জল্পনা-কল্পনা আর ভিন্নমত । তারই ধারাবাহিকতায় অভিশপ্ত মেডুসার কল্পকাহিনীও ব্যতিক্রম নয় ।
এক মিথে দেখা যায়, মেডুসা ছিলেন সোনালি চুলের এক অপূর্ব সুন্দরী কুমারী নারী ! মেডুসা অনেক অনেক উত্তরে বসবাস করতেন এবং কখনো সূর্যের আলো দেখেন নি । তিনি দেবী অ্যাথেনার মন্দিরের ধর্মযাজিকা ছিলেন । তিনি অ্যাথেনার কাছে অনুমতি চাইলেন দক্ষিণে আসতে । কিন্তু অ্যাথেনা অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালে মেডুসা রাগান্বিত হয়ে বলেন, “অ্যাথেনা আমাকে দক্ষিণে আসতে দিতে চায় না, কারণ আমি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী !” ক্ষুব্ধ অ্যাথেনা মেডুসার সৌন্দর্যই শুধু দূর করলেন না, তাকে এতো কুৎসিতে রূপান্তরিত করলেন যে, কোন মানব বা প্রাণী তার দিকে তাকালেই পাথরে পরিণত হয়ে যেতো । মেডুসার অপূর্ব সুন্দর চুল পরিণত হয় বিষাক্ত সাপে, কোমল চোখজোড়া রূপান্তরিত হয় মৃত্যুর দূত হিসেবে, দুধে আলতা ত্বক সাপের চামড়ার মতো সবুজাভ হয়ে যায় ।
আবার মহাকাব্য অনুসারে মেডুসা ছিল এক সুন্দরী কুমারী । অ্যাথেনার মন্দিরের পূজারিণী হওয়ায় পার্থিব কামনা বাসনা পরিত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে । মেডুসার অসম্ভব রূপ‚ তাঁর দীঘল সোনালী চুল সমুদ্র দেবতা পোসাইডনকেও আকৃষ্ট করে তুলল । একদিন কোনও এক অভিশপ্ত মূহুর্তে অ্যাথেনার মন্দিরেই পোসাইডনের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন মেডুসা । ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত নাকি পোসাইডন জোর করে তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন‚ সেটা নিয়েও দ্বিমত আছে । কিন্তু পবিত্র মন্দিরের মধ্যে শারীরিক মিলন যে নিষিদ্ধ – সে যতই পোসাইডন সমুদ্রের দেবতা হোন না কেন । অ্যাথেনা তাঁর মন্দিরে এমন একটি ঘটনা ঘটায় ক্ষেপে যান। যেহেতু তিনি পোসাইডনকে কিছু বলতে পারবেন না, তাই তাঁর সব রাগ মেডুসার ওপর ঝাড়েন । আর এরই ফলশ্রুতিতে অভিশপ্ত জীবন শুরু হয় মেডুসার । উল্লেখ্য, পোসাইডনের সাথে মিলনের ফলে মেডুসা গর্ভবতী হয়ে পড়েন । মেডুসার পক্ষ নিতে যাওয়ায় তাঁর বাকি দুই বোনকেও শাস্তিস্বরূপ এমন কুৎসিত করে দেয়া হয়।
নিজের কুৎসিত অবস্থা দেখে মেডুসা বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যায় । এবং ক্ষোভ পরিণত হয় হিংস্রতাতে। সে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে থাকে শান্তি পাবার আশায়, তখন মাথা থেকে মাঝে মাঝে সাপ খসে পড়তো সেখানকার মাটিতে। সেজন্যেই নাকি আফ্রিকাতে নানা ধরণের বিষাক্ত সাপের আবাস!(যদিও সবই মিথ)। মেডুসার অস্ত্র ছিল একটি বড় ধনুক। কিন্তু এর আসল অস্ত্র ছিল তাঁর চোখ। ওই চোখে যে চোখ রাখতো, সঙ্গে সঙ্গে সে পাথরে রূপান্তরিত হতো । যারা তাঁর গুহায় তাঁকে হত্যা করার জন্য যেত, কেউই আর ফেরত আসতো না। গর্গন দানবীদের কথা আসলেই যে গ্রীক বীরের নাম উচ্চারিত হয়, সেটা হল জিউস পুত্র পার্সিউস । এই গ্রীক বীর ডেমিগড (অর্ধেক মানব‚ অর্ধেক দেবতা) পার্সিউসের (অন্য আরেকটি পর্বে পার্সিউস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে) হাতেই মৃত্যু হয় মেডুসার । রাজা পলিডেকটাস একবার এই তিন দানবীর গল্প করলো পার্সিউসের কাছে এবং কথায় কথায় এমনও বলল যে, কেউ যদি ওদের একজনের মাথা কেটে এনে দিতে পারে তবে সেটাই হবে তার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার । রাজার এক ভোজসভায় নিমন্ত্রিত অতিথিরা রাজাকে নানারকম উপঢৌকন দিল । কিন্তু পার্সিউসের দেয়ার মতো কিছু নেই । রাজা এ নিয়ে একটু কটাক্ষও করলেন । তরুণ এবং অহংকারী পার্সিউস অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি রাজাকে এমন উপহার দেব যা এখানকার সকল সামগ্রীর চেয়ে মূল্যবান । আমি মেডুসার কাটা মুণ্ডু এনে হাজির করব রাজার সামনে ।”
পার্সিউসের এই পরিকল্পনায় পত্রবাহক দেবতা হার্মিস এবং দেবী অ্যাথেনাও সাহায্য করেছিলেন । অ্যাথেনার দেয়া ব্রোঞ্জের ঢাল, হার্মিসের দেওয়া তরবারি এবং তাদের সহায়তায় নিম্ফদের কাছ থেকে সংগৃহীত পাখাওয়ালা চটিজুতা, একটি জাদুর থলে যার ভেতরে যত বড় জিনিসই রাখা হোক না কেন এঁটে যাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি যাদুর টুপি যেটি পড়লে পরিধানকারী সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায় সবকিছু নিয়ে গর্গনদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় পার্সিউস । অ্যাথেনা পার্সিউসকে সাবধান করে দিলেন, যাতে গর্গনদের দিকে সে না তাকায়, বরং তার ঢালের দিকে তাকাতে যেটা একটা আয়নার মতো কাজ করবে এবং তার সাহায্যে সে গর্গন বধে সফল হবে। দেবীই দেখিয়ে দিলেন কোনজন মেডুসা । ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, তিন বোনের মাঝে কেবল মেডুসা ছাড়া বাকি দুইজন অমর ছিল । পাখাওয়ালা পার্সিউস উড়ে উড়ে লক্ষ্য রাখতে লাগলো ঘুমন্ত মেডুসাকে ঢালের দিকে চোখ রেখে- সরাসরি তাকালে সে পাথর হয়ে যেতো । একসময় সুযোগ বুঝে মেডুসার গলা তাক করে তরবারি চালালো । ঢাল থেকে চোখ না সরিয়েই সে নেমে এলো নিচে এবং মেডুসার সাপের ঝুঁটিওয়ালা মাথা খামচে ধরলো । যাদুর থলেতে কাঁটা মন্ডুটি ঢুকিয়ে ফেললো । এভাবেই সে মেডুসার জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করলো । ততক্ষণে অন্য দুই গর্গন বোন জেগে উঠলেও তাদের আর কিছুই করার ছিল না কারণ পারসিউস নিরাপদ দূরত্বে উড়ে যেতে সক্ষম হয় যাদুর টুপি আর পাখার সাহায্যে ।
পার্সিউস মেডুসার মাথা থলিতে ভরে নিয়ে আসার সময় মেডুসার মাথা থেকে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ে সমুদ্রে । পূর্বেই উল্লেখ করেছি মেডুসা গর্ভবতী ছিলেন সমুদ্রদেবতা পোসাইডন এর সাথে মিলনের ফলে । এইবার ঐ রক্তবিন্দু সমুদ্রে পড়া মাত্রই সেখান থেকে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত ঘোড়া- পেগাসাস! এমনকি পথিমধ্যে টাইটান অ্যাটলাস(যিনি তার কাঁধে বহন করেছিলেন পুরো পৃথিবী) এর সাথে বাক-বিতণ্ডায় জড়ালে পার্সিউস মেডুসার কাঁটা মাথার চোখের সাহায্যে তাকে পাথরে পরিণত করেন । আর এভাবেই উত্তর আফ্রিকার অ্যাটলাস পর্বতমালার সৃষ্টি হয় । আবার অন্য আরেকটি কাহিনীও প্রচলিত আছে মেডুসা বধ নিয়ে ।
আর্গোস রাজ্যের রাজা ও রাণী দেবতাদের অবমাননা করায় তাঁরা ক্ষেপে ক্র্যাকেন নামের বিশাল জলদানব পাঠায় তাঁদের ধ্বংস করার জন্য! যেই দানবকে হত্যার কোন অস্ত্র ছিলোনা । দেবতারাও যাকে ভয় করতো । শর্ত ছিল রাজকুমারীকে বলি দিতে হবে এর কাছে, নইলে সবাইকেই মরতে হবে । পরে জানা গেল একমাত্র মেডুসার চোখের দৃষ্টিই পারবে একে হত্যা করতে । শেষে জিউসের পুত্র পার্সিউস রাজকুমারীকে রক্ষার জন্য রওনা হয় মেডুসাকে হত্যা করার জন্য এবং পার্সিউস তাঁর মাথা কাটতে সফল হয়। এবং সেই মাথা ক্র্যাকেনের সামনে ধরে ওকে পাথরে রূপান্তরিত করে ফেলে । মেডুসাকে হত্যার পর তাঁর কাঁটা মাথার জায়গা থেকেই জন্ম হয় পেগাসাস ও ক্রিসেওর এর !
মেডুসাকে দানবী হিসেবে ধরা হলেও সুরক্ষা চিহ্ন হিসেবে অনেক বর্ম ও ঢালের গায়ে এর মাথার চিহ্ন খোদাই করা হতো । পার্সিউস আর মেডুসার এই উপকথা প্রাচীনকালের অনেক সাহিত্যিক ও শিল্পীদের অনুপ্রেরণা । তাদের চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য ও সাহিত্যকলায় এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি বহুলভাবে সমাদৃত । অনেক প্রাচীন মুদ্রাতেও এর চিহ্ন পাওয়া যায় । মেডুসা বর্তমান আধুনিক সভ্যতার সাথেও মিশে গিয়েছে । ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের প্রধান নগরচত্বরে দেখা যায় পার্সিউস এবং মেডুসার বিখ্যাত স্থাপত্য কর্মটি । প্রতিবছর বহু পর্যটক স্থাপত্যটি দেখার উদ্দেশ্যে ফ্লোরেন্স শহর পরিদর্শনে যান ! এমনকি বিখ্যাত ইতালিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ড ভার্সাচি (Versace) এর লোগোতেও স্থান পেয়েছে মেডুসার মাথা !