রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ভুয়া নিবন্ধনকৃত মোবাইল ফোনের প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিমকার্ড। বেআইনি হওয়ায় এসব সিমের দামও চড়া। ফুটপাত, মুদি দোকান থেকে শুরু করে অলিগলিতে প্রকাশ্যে এমন সিম ১৫শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সিমকার্ড বিক্রির কারণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রযুক্তিগত অপরাধ। অনিবন্ধনকৃত সিম ব্যবহার করে অপহরণকারী, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। অথচ এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে সরকার সিম পুনঃনিবন্ধনের মতো একটি বিরাট মহাযজ্ঞ বাস্তবায়ন শেষ করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সবই যেন বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একাধিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নাম, ঠিকানা ও ছবি জালিয়াতি করে চড়া মূল্যে বাজারে প্রি-অ্যাক্টিভেটেড এসব সিম বিক্রি করছে একটি অসাধু চক্র। কোনো ধরনের পরিচয়পত্র ছাড়াই ঢাকার ফুটপাতে দেদার বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির সিম। চাহিদামতো টাকা দিলে সহজেই মিলে যাচ্ছে তা। বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতারণায় ব্যবহূত এসব সিমকার্ডের আসল মালিক জানেনই না তার নামে নিবন্ধন করা সিমকে কী কাজে ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, অপহরণ চক্র, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি, করোনা টেস্টের ফল পরিবর্তন, ইমো প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে প্রতারকদের মূল হাতিয়ার ফুটপাতে বিক্রি করা এসব প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিমকার্ড। গত ১৫ মে বিদেশগামী যাত্রীদের জিম্মি করে কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট সমস্যার সমাধানের কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়া একটি চক্রের ৭ সদস্যকে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করেই এসব প্রতারণা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল তারা। চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের সময়ে বেশ কিছু বেনামি সিম উদ্ধার করা হয়। আর এই সিমগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, রাজউক মার্কেট, যাত্রাবাড়ী, মহাখালীসহ সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার বেশ কিছু মোবাইল ফোন এক্সসরিজের দোকানে এ ধরনের সিম সহজলভ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিম পুনঃনিবন্ধন ও ক্রয় করার সময় অসচেতন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একাধিকবার আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। মূলত ওইসব আঙুলের ছাপের সঙ্গে ভুয়া নাম-ঠিকানা ও ছবি যুক্ত করে বাজারে চড়ামূল্যে সিম বিক্রি করছে চক্রটি। গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফোন কোম্পানিগুলোর কারো না কারো সমপৃক্ততা ছাড়া এভাবে প্রি-অ্যাক্টিভেট সিম পাওয়া সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী তার জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্ট এনআইডি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জন্ম নিবন্ধন সনদের বিপরীতে ১৫টি করে প্রায় ৭৫টি পর্যন্ত সিমকার্ড কিনতে পারতেন। বিটিআরসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নতুন সংযোগ কিনতে হলে অবশ্যই ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড জমা দিতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাছে আঙুলের ছাপ দেয়ার পর তা ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে মিললে সিম কেনা যাবে। এরপর বিটিআরসি সংযোগটি সক্রিয় করবে। এ নিয়মের বাইরে কোনোভাবেই সিম চালু হওয়ার সুযোগ নেই। সম্প্রতি, বিটিআরসি বৈধভাবে একজন গ্রাহকের সর্বোচ্চ ৭৫টি সিম কেনার নির্দেশনা বাতিল করেছে।
সংস্থাটি জানায়, অবৈধ সিমকার্ডের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধমূলক কাজ বন্ধ করার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর বদলে একজন গ্রাহককে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই দুটি সিমকার্ড কেনার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তবে শর্ত হচ্ছে, কেনার পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের মাধ্যমে এনআইডি কার্ডের বিপরীতে সিমগুলো নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধন করা না হলে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। সিমকার্ড ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ দমন বিষয়ে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মনিটরিংয়ের অভাবে বিটিআরসির এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না।
একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিটিআরসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি জন্ম নিবন্ধন সনদের বিপরীতে ১৫৪ ব্যক্তি ১৫টি করে সিমকার্ড নিয়েছেন। এছাড়া একটি পাসপোর্টের বিপরীতে ১৫টি করে সিমকার্ড নিয়েছেন ৮৪ জন। আর একটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১৫টি করে সিমকার্ড নিয়েছেন ২৬ ব্যক্তি।
গত ২৪ জানুয়ারি ভয়ংকর তিন সাইবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা কেউ অষ্টম শ্রেণিও পাস করেনি। অথচ তারা যেসব সিমকার্ড দিয়ে বিকাশ, নগদ, শিওর ক্যাশসহ অন্যান্য অ্যাপস ব্যবহার করে টাকা লেনদেন হয়, সেইসব মোবাইল ফোনের সিমকার্ড ক্লোন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছে বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির ২৪টি ক্লোন বা স্পোফিং করা সিম ও ১৩টি মোবাইল পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সিমকার্ডগুলো কিনেছিল অপরাধীরা। ওইসব সিমকার্ড রিকশাচালক, ভ্যানচালক, খেটে খাওয়া মানুষ সহজ-সরল মানুষদের এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল বলে জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আহসান হাবিব বলেন, মোবাইল ফোনের সিমকার্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হলে প্রযুক্তিগত অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে প্রায় সব প্রযুক্তি বা অ্যাপস ব্যবহার করতেই মোবাইল ফোনের সিমকার্ড প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে সব ধরনের প্রতারণার মূলে রয়েছে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম। অনলাইনে প্রতারণার ক্ষেত্রে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন বা অনিবন্ধিত সিম ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতারণার কাজে ব্যবহূত ৮০ ভাগ সিম অন্যের নামে নিবন্ধন করা। যেসব সিম ব্যবহার করে সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন ধরনের যে অপরাধগুলো হচ্ছে, তাতে প্রকৃত অপরাধীদের ট্র্যাকিং করে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। কারণ, এই সিমগুলো ভুয়া না, বেওয়ারিশও না। সমাজের সাধারণ ও নিম্নবিত্ত মানুষদের অর্থের বিনিময়ে ভুল বুঝিয়ে সিমগুলো তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে একটি চক্র। ফলে সিম দিয়ে অপরাধ করার পরে যাদের পাওয়া যায় তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়। আর যারা অপরাধ করছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করেও বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদারের বক্তব্য নেয়া যায়নি। সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মিত্র বলেন, ফুটপাতের সিম ব্যবহার করে অপরাধ হয়, এ অভিযোগ সত্যি। বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন বিভাগ এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব অপরাধে জড়িতদের ধরছে। চোর-পুলিশ বিষয়টা চিরকাল চলে। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা কাজ করছি।