অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে সম্পূর্ণ আলাদা রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক বেশ জটিল ও পুরোনো। প্রায় ১১ মাস আগে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ মধ্য দিয়ে খানিকটা আড়ালে থাকা ওই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
ইতোমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ২৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে রাশিয়া। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ওই যুদ্ধে উভয়পক্ষের প্রায় এক লাখ করে সেনা নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের অবকাঠামো যতটা ধ্বংস হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সূচকে সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ইউক্রেন ‘যুদ্ধে’ জড়াল কেন, এ প্রশ্ন শুরু থেকেই উঠেছে। এর অনেকগুলো উত্তর আছে। এমনই এক উত্তর খুঁজেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্র্যান্ডন জে সফটস। উত্তর খুঁজতে তিনি যতটা না ইউক্রেন, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। কারণ আরও অনেকের মতো তিনিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করেন।
এশিয়া টাইমসে এক বিশ্লেষণে ব্র্যান্ডন জে সফটস লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রধান বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার মধ্যে এক ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক গরিমা দেখা দেয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে সে নিজের আধিপত্য বিস্তারে মনোযোগী হয়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশন ব্যর্থ হতে থাকে। বিশেষ করে, গত ৩০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের মিশন কখনই সফল হয়নি। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও এক ধরনের ইগো বা জেদের বশবর্তী হয়ে সে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। তার চেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশন যে কারণে ব্যর্থ: ব্র্যান্ডন জে সফটস মনে করেন, আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশন ব্যর্থ হওয়ার একাধিক কারণ আছে। যদি কোনো একটি কারণকে এককভাবে দায়ী করতে হয়, তা হলো- বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক লক্ষ্যের অভাব। প্রুয়েশিয়ার উনিশ শতকের আর্মি জেনারেল ও সামরিক তাত্ত্বিক কার্ল ভন ক্লজউইৎসকে উদ্ধৃত করে ব্র্যান্ডন জে সফটস লেখেন, যুদ্ধ সব সময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই যুদ্ধের ফল কেমন হবে, তা সর্বদা রাজনীতি ও সমরনীতির যৌথ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। আফগানিস্তান ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তে সমন্বয় ছিল না। ইরাকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পুরোটাই ভুল ছিল। আফগানিস্তানে দুই ক্ষেত্রেই ত্রুটি ছিল।
ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের একই ভুল: ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পূর্ণ এড়ানো যেত বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ব্র্যান্ডন জে সফটস। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কারণে তা সম্ভব হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ হামলা শুরুর প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেন নিয়ে যে কৌশল নিয়েছিল, তা বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন ব্র্যান্ডন জে সফটস। তখন রাজধানী কিয়েভ ও পশ্চিম অঞ্চলকে রুশ অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তা সফলও হয়। কিন্তু এরপর মার্কিন কৌশলবিদদের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। তারা ক্রিমিয়াসহ পূর্ব ইউক্রেনের অধিকৃত সব অঞ্চল থেকে রুশদের তাড়ানোর ঘোষণা দেয়। শুধু তাই নয়, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো ও রাশিয়াকে বিভক্ত করার আকাশকুসুম স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। ব্র্যান্ডন জে সফটসের ধারণা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগলেও রাশিয়ার বিভক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি : যুদ্ধে ইতোমধ্যে রাশিয়া যতটা বিনিয়োগ করেছে বা জড়িয়ে পড়েছে, তাতে করে পূর্বাঞ্চলের দনবাসের অধিকাংশ ভূখণ্ড দখলে না নিয়ে ছাড়বে না মস্কো। এ অবস্থান থেকে তাদের পিছু হটার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কিয়েভের হাতে নেই। তা এখন ওয়াশিংটনের হাতে। অবশ্য শুরু থেকে তাই ছিল। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকেই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। আর তা না করলে ইউক্রেনের ট্র্যাজেডি আরও গভীর হবে। তিন দশক ধরে আলোচিত বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটবে। মলিন হবে ওয়াশিংটনের একাধিপত্য। বুদ্ধিবৃত্তিক, সামরিক ও অর্থনীতি উভয় দিক থেকে এটা ঘটবে।