জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারীর মতো বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। এসব কারণে দুই বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে সব ধরনের পণ্য উৎপাদন, উত্তোলন ও বাণিজ্য ছিল নানামুখী প্রতিবন্ধকতার মধ্যে। তার ওপর ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এতে পণ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলোয় ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে।
যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নয়, সেসব দেশ আরো বেশি আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পণ্যের চাহিদা। কিন্তু মহামারীর ধাক্কা এবং কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। তার ওপর কনটেইনার সংকট, অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, শুল্ক বৃদ্ধিসহ নানা জটিলতা তো রয়েছেই। এসব কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলো চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। এতে চাপের মুখে পড়ছে অর্থনীতি। জীবন-মান ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি তীব্র হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলো কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের বিকল্প উৎসে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
আনাদোলু এজেন্সির সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলো উচ্চমাত্রার রফতানি আয়ের সুবিধা লাভ করছে। কিন্তু ঠিক একই সময় পণ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলো সরবরাহসংক্রান্ত জটিলতা ও ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, মার্চে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক দাম প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। গত মাসে খাদ্যপণ্যের গড় মূল্যসূচক ১৫৯ দশমিক ৩ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অথচ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যসূচক ছিল ১৪১ দশমিক ৪ পয়েন্টে। তখন এটিই ছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ দাম। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে পণ্যসামগ্রীর বৈশ্বিক দাম লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। এছাড়া গত দুই বছর করোনাভাইরাসের সঙ্গে অব্যাহত লড়াই বাজারে আরো বড় অস্থিরতার জন্ম দেয়। এর মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইউক্রেন ও রাশিয়া। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ইউক্রেনের ওপর হামলা ও নিপীড়ন চালানোয় পশ্চিমা দেশগুলোর রোষের মুখে পড়েছে রাশিয়া। দেশটির অর্থ ব্যবস্থা ও ব্যাংক খাতের ওপর কয়েক ধাপে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও গ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ রফতানিকারক দেশ। এছাড়া ধাতব ও কৃষিপণ্য রফতানিতেও দেশটির অবস্থান অনেক এগিয়ে। এ কারণে অনেক দেশই দেশটির এসব পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
অব্যাহত নিষেধাজ্ঞার পর বাড়তে থাকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের দাম। এক ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। এদিকে জ্বালানির অত্যধিক দাম ও সংকটে কমছে ধাতব পণ্য উৎপাদনও। ফলে দীর্ঘ সময় ধরেই এসব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। বর্তমানে বৈশ্বিক পণ্য রফতানি প্রায় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর মধ্যে যুদ্ধসংক্রান্ত সরবরাহ জটিলতা আবারো পণ্যের দাম বাড়াতে সহায়তা করছে।
যেসব দেশে জ্বীবাশ্ম জ্বালানির পর্যাপ্ত ভূগর্ভস্থ মজুদ নেই, তাদের জন্য অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা সমাধান হিসেবে একটি বিকল্পের কথাই বলছেন, তা হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের বৈশ্বিক ভূগর্ভস্থ মজুদের এক-পঞ্চমাংশই রয়েছে রাশিয়ায়। দেশটি বিশ্বের শীর্ষ গ্যাস সরবরাহকারী। ইরান ও কাতারও গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী। গ্যাসের বৈশ্বিক বাজারে ইরানের ১৭ দশমিক ১ ও কাতারের ১৩ দশমিক ১ শতাংশ হিস্যা রয়েছে।
অন্যদিকে ভেনিজুয়েলায়ও জ্বালানি তেলের বৃহৎ মজুদ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশটির হিস্যা ১৭ দশমিক ৫, সৌদি আরবের ১৭ দশমিক ১ ও কানাডার ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হিস্যা রয়েছে। অনেক দেশেই জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী অত্যন্ত সীমিত। এতে বিশ্বজুড়ে এসব পণ্যের আমদানিনির্ভরতা ব্যাপক আকার ধারণ করছে।