কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে শারীরিক
নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ পায়নি পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই। আদালতে এ সংক্রান্ত
প্রতিবেদন দাখিল করেছে পিবিআই। আগামী ২৪ নভেম্বর ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত
হবে।
বুধবার (১৭ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা
জজ আদালত সূত্র জানায়, গত ১৭ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান কিশোরকে শারীরিক
নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ না পাওয়ায় বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন,
সাদা পোশাকে অজ্ঞাতনামা ১৬-১৭ জনের বিরুদ্ধে আনা কিশোরকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ
প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।
গত ২০ মার্চ কিশোরের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করে শরীরে (কান, পা ও শরীরে) আঘাতের চিহ্ন পায়নি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের
তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড।
গত ২০ মার্চ ঢামেকের নাক-কান-গলা (ইএনটি)
বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমী, অর্থোপেডিক বিভাগের বিভাগীয়
প্রধান অধ্যাপক ডা. ফখরুল আমিন খান ও মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. হাফিজ
সর্দার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই প্রতিবেদনে কিশোরের
শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন তারা।
গত ১০ মার্চ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজ্ঞাত সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা দায়ের
করেন। কান, পা ও শরীরের যেখানে আঘাত পেয়েছেন বলে কিশোর যে অভিযোগ করেছেন, সেগুলো পরীক্ষা
করতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে নির্দেশ
দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ।
অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ৫ মে ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর গ্রেফতার হন। কিন্তু তার তিন দিন আগে
২ মে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে বাসা থেকে সাদা পোশাকধারী ১৬-১৭ জন লোক তাকে মুখোশ পরিয়ে
হাতকড়া লাগিয়ে নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর ২ মে থেকে ৩ মে পর্যন্ত তাকে বিভিন্নভাবে
নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগে কিশোর বলেন,
‘গত বছরের ২ মে
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বাসার কলিং বেলে আমার ঘুম ভাঙে। দরজা খুললেই অপরিচিত এক লোক
আমাকে বলেন দরজা খোলেন না কেন? পরনের লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে নেন। সাথে একটা ভালো
শার্ট পরেন। আমি পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তারা আমাকে পরিচয় দেয় নাই। আলাপ-আলোচনায় তাদের
একজনকে জসিম বলে ডাকতে শুনি। সবাই ঘরে ঢুকেই তল্লাশি শুরু করেন। তারা আমাকে কোনও গ্রেফতারি
পরোয়ানা দেখাতে পারেনি। বাসা থেকে আমার মোবাইল ফোন, সিপিইউ ও পোর্টেবল যত ধরনের ডিজিটাল
ডিভাইস ছিল তা অবৈধভাবে নিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন হাতকড়া
পরিয়ে বাসার নিচে নামানো হয়, তখন বাসার সামনে ৬-৭টি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমার বাসার
সামনে অনেক লোকজন জড়ো হয় এবং একটি গাড়িতে আমাকে ওঠানো হয়। আমি তখন প্রচণ্ডভাবে
জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু তারা গাড়িতে অনেক জোরে জোরে শব্দ করে গান বাজনা
বাজাচ্ছিল। হয়তো আমার চিৎকার বাইরে শোনা যাচ্ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরে আমি বুঝতে
পারলাম আমাকে পুরনো একটি স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির রুমে নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রজেক্টরের
মাধ্যমে একটির পর একটি কার্টুন আমাকে দেখানো হচ্ছিলো। সেগুলোর মর্মার্থ আমার কাছ থেকে
জানতে চাওয়া হচ্ছে। করোনা নিয়ে আমার কিছু কার্টুন দেখিয়ে বলে কেন এগুলো আঁকছস? কার্টুনের
চরিত্রগুলোর বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়। একপর্যায়ে আমার কানে প্রচণ্ড জোরে আঘাত
করা হয়। এরপর আমি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। বুঝতে পারছিলাম আমার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে
পড়ছে। তারপর স্টিলের পাতের লাঠি দিয়ে আমার পায়ের হাঁটুতে আঘাত করা হয়। যন্ত্রণা
ও ব্যথায় আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি।’
কিশোর বলেন, ‘এভাবে কয়েক দফা আমার ওপর শারীরিক ও মানসিক টর্চার অত্যাচার চালায় তারা। পরে আমি নিজেকে র্যাব কার্যালয়ে দেখতে পাই। র্যাবের কার্যালয়ে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুশতাক আহমেদ আলাপের সময় আমাকে জানান তাকেও বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ৬ মে আমাদের রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, হাঁটতে পারি না, হঠাৎ করে পড়ে যাই এবং শরীরে আরও নানাবিধ রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।’