বেলারুশ সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসন্তের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত ইউক্রেনের বাহিনী। বহু পুরোনো টি-৭২ ট্যাংক গোলা ছুড়ে এবং পরিত্যক্ত ভবনে সেনাসদস্য প্রবেশ করিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন করছে তারা। সেনারা যখন এ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ইউক্রেনের বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেরহি নাইয়েভকে দেখা গেল অস্ত্রের সরবরাহ বুঝে নিতে। ভারী মেশিনগান, আকাশযানবিধ্বংসী অস্ত্র, সবই রয়েছে তাতে।
নাইয়েভের বিশ্বাস, যুদ্ধের পরবর্তী ধাপে মুখ্য ভূমিকা রাখবে ট্যাংক।তবে নিজেদের পুরোনো টি-৭২ ট্যাংকের ওপর আস্থা নেই তার। জার্মানির লেপার্ড ২ এবং ব্রিটিশ চ্যালেঞ্জার ট্যাংক এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তিনি।
নাইয়েভ বলেন, অবশ্যই আমাদের প্রচুরসংখ্যক পশ্চিমা ট্যাংকের প্রয়োজন। কারণ, সেগুলো সোভিয়েত মডেলের চেয়ে অনেক বেশি ভালো এবং আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করতে পারবে। আমরা নতুন সামরিক ইউনিট তৈরি করছি। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতির ওপর। এজন্যই পশ্চিমা সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কয়েকশ ট্যাংক প্রয়োজন। এগুলো তাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং সামনের মাসগুলোতে শত্রুর সঙ্গে লড়তে সহায়তা করবে।
মূলত লেপার্ড ২ ট্যাংকই চাইছে ইউক্রেনের বাহিনী। কারণ, এটি ঠিক রাখা এবং পরিচালনা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বহু ন্যাটো দেশ এখনও এটি ব্যবহার করছে। ইউক্রেনের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অনেকেই ধারণা করেছিলেন রামস্টেইনের বৈঠকের পর তাদের আহ্বানে সাড়া মিলবে। তবে জার্মানি বাদ সাধায় ভেস্তে গেছে সে আশা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্সিয়াল প্রশাসনের উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমরা এটি নিয়ে হতাশ। আমরা বুঝতে পারছি যে কিছু দেশের বাধা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে যত দেরি করা হবে, আমাদের সৈনিক ও বেসামরিক মানুষ তত বেশি মারা যাবে। পদোলিয়াক আরও বলেন, জার্মানি এখানে নেতৃস্থানীয় অবস্থান নিলে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য হতো।
ইউক্রেনের এ উপদেষ্টার মতে, তাদের তিনশ থেকে চারশ ট্যাংকের প্রয়োজন পড়বে। যা দুই থেকে তিন হাজার সোভিয়েত আমলের ট্যাংককে পেছনে ফেলতে পারবে। এতে করে যুদ্ধের গতিতে পরিবর্তন আসবে এবং এটিকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পুরোনো ট্যাংক নিয়ে একটি দিক থেকে সমস্যায় রয়েছে ইউক্রেন। আর তা হলো, বাড়তি যন্ত্রাংশের সংকট। পুরোনো মডেলের হওয়ায় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সারাইয়ের যন্ত্রাংশ।
ইউক্রেনীয়দের আশঙ্কা, দুই মাসের মধ্যেই রাশিয়ার হামলা শুরু হতে পারে। গত শরতে নিজেদের সেনাবাহিনীতে দেড় লাখ সেনা অন্তর্ভুক্ত করেছে রুশরা। বসন্ত নাগাদ তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়ে যাবে। ফলে ইউক্রেনের জন্য বর্তমানের পুরো পরিস্থিতিটাই হচ্ছে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতাস্বরূপ। এরই মধ্যে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এম১ আব্রামস ট্যাংক পাবে না ইউক্রেন। কারণ, ট্যাংকগুলো শক্তিশালী হলেও এগুলো ঠিক রাখা ও পরিচালনা করা কঠিন। পেন্টাগনের শীর্ষ নীতিনির্ধারক কলিন কাহল এ প্রসঙ্গে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এম১ ‘দামি এবং এতে প্রশিক্ষণ নেওয়া কঠিন। এতে রয়েছে জেট ইঞ্জিন।’
জার্মান ট্যাংক যুদ্ধে গুরুতর ভূমিকা রাখতে পারবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) জ্যেষ্ঠ গবেষক জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, ‘লেপার্ড ২ আধুনিক এবং ভালো সেন্সরসমৃদ্ধ সুরক্ষিত মূল যুদ্ধ ট্যাংক’ হতে পারবে। ইউক্রেন অবশ্য ক্রমাগত নতুন অস্ত্র পাচ্ছে। সেগুলোকে নিজস্ব কাঠামোর মধ্যেও যুক্ত করছে তারা। কিন্তু এটিরও সমস্যা রয়েছে। সামরিক বাহিনীকেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে তাদের। এ কারণেই নাইয়েভ মনে করেন, পুরো ইউনিটের একটি মাত্র বাহন থাকতে হবে। গোটা ব্যাটালিয়নের হয় ব্র্যাডলি, না হয় লেপার্ড ট্যাংক থাকা উচিত। তবে অনেক সমালোচকই বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে ভারী ট্যাংক পাঠালে তা ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। এতে করে ন্যাটোর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা আখেরে যুদ্ধের পরিসর বাড়িয়ে তুলবে।
পদোলিয়াক অবশ্য তা মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, দ্রুত আধুনিক ট্যাংকের সরবরাহ করা হলে তা যুদ্ধকে স্থানীয় পরিসরে বেঁধে ফেলবে। তিনি বলেন, এটি ছড়াবে না, অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যে থাকবে এবং ট্যাংক যুদ্ধের মাধ্যমেই সবকিছু নির্ধারিত হবে। আমরা বুঝতে পারছি, কিছু দেশ এই যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরাই মূলত স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করছি। রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে আমাদের মানুষ মারা যাচ্ছে।
রুশরা যা বলছে: কিয়েভে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা আক্রমণাত্মক অস্ত্র বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে বলেই মনে করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহচর ভায়াচেস্লাভ ভলোদিন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে প্রকারান্তরে বিশ্বকে একটি ‘ভয়ানক যুদ্ধের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে ভলোদিন লিখেছেন, ওয়াশিংটন এবং ন্যাটো দেশগুলোর সরবরাহ করা অস্ত্র আমাদের ভূখণ্ড দখলের চেষ্টায় এবং বেসামরিক নাগরিকদের বসবাসের এলাকাগুলোতে আঘাত হানতে ব্যবহার করা হবে। যেমনটি তারা হুমকি দিয়েছে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় আরও শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহারের বাস্তবতা তৈরি হবে।