মৌসুমি বৃষ্টিপাতের
ফলে পাকিস্তানে এ বছর প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। ধ্বংস হয়েছ শত শত বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবন। পানি নেমে যেতে শুরু
করায় বন্যার ক্ষত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি
খাদ্যসংকট নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটিতে এবারের বন্যার ফল হতে
পারে সুদূরপ্রসারী।
পাকিস্তানে
এবারের বন্যায় ৩ কোটি ৩০ লাখের ওপর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ১ কোটি ৬০
লাখই শিশু। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৭০ লাখের ওপর মানুষ। প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় দেড়
হাজার। দেশটির জনসাধারণ যখন জলবায়ু পরিবর্তন ও রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতির মতো কঠিন
সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল তখনই এই দুর্যোগ সেখানে আঘাত হানল। বন্যায় দেশের
প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস সম্প্রতি পাকিস্তান
সফরের পর পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো চিত্রই বিপর্যয়ের প্রকৃত অবস্থা
তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট নয়’। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের দেশ পর্তুগালের সমপরিমাণ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যায়
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশ। সেখানে বেশির ভাগ এলাকা দেশের
বাদবাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
যদিও আন্তর্জাতিক
ত্রাণসহায়তা আসতে শুরু করেছে তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বন্যার ফলে দেশটি দীর্ঘমেয়াদি
আর্থিক সংকটের ফাঁদে আটকাতে পারে। সরকারিভাবে অবশ্য বলা হচ্ছে, পানি নেমে গিয়ে পরিস্থিতি
স্বাভাবিক হতে ছয় মাস সময় লাগবে। দেশটির কর্মকর্তারা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও
(ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছে, এই সময়ের মধ্যে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে গিয়ে জনস্বাস্থ্য
হুমকির মুখে পড়তে পারে। ডব্লিউএইচওর পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় আঞ্চলিক পরিচালক আহমেদ মানজারি
বলেছেন, ‘লাখ লাখ মানুষ এখনো সুপেয় পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকটের মধ্যে
আছে। বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রাথমিক রিপোর্টে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের
প্রাদুর্ভাবের কথা বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনাজনিত কারণে সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। পাকিস্তানের
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক আনমোল ইরফানও তাই মনে করেন। সম্প্রতি ফরেন পলিসি সাময়িকীতে
লিখেছেন, ‘সন্দেহ নেই এটি এক নজিরবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা
ও রাজনীতিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। কাজেই
এটি কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানবসৃষ্ট সমস্যাও এই দুর্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রলয়ংকরী এ
বন্যায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কৃষি ও পশুসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাড়ে ৭
লাখের ওপর গবাদি পশু মারা গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে বিপুলপরিমাণ কৃষিজমি। ফলে পাকিস্তান
নয় শুধু, বরং দেশটির ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য দেশেরও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিতে
পারে অনিশ্চয়তা। করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর এই বন্যা হলো। ফলে স্বাভাবিকভাবে
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার
কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুই বছরের বেশি স্থবির ছিল। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধ
বহুদেশে খাদ্যসংকট তৈরি করেছে। তাছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক সংকট ও নিত্যপ্রয়োজনীয়
জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল। যখন
তারা এই সংকট কিছুটা কাটাতে আরম্ভ করে ঠিক তখনই আঘাত হানে এই বন্যা।
বিশেষজ্ঞরা
এবারের বন্যার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। সিন্ধু প্রদেশে এবার স্বাভাবিকের
চেয়ে ৯ গুণ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সারা দেশে বৃষ্টিপাত বেড়েছে পাঁচ গুণ। বৈশ্বিক উষ্ণতা
বৃদ্ধির ফলে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫ শতাংশ বেড়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির
ফলে উত্তরের হিমবাহগুলো দ্রুত গলে গিয়ে নদনদীতে পানির পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়।
পাকিস্তানে বন্যার আগে বাংলাদেশ ও ভারতে বন্যা হয়। পাকিস্তানে এর আগে ২০১০ সালে ব্যাপক
বন্যা হয়েছিল। এবারের বন্যার তীব্রতা তার চেয়ে অনেক বেশি। ২০১০ সাল থেকেই বন্যা ও দাবদাহ
দেশটিতে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ইতিমধ্যেই
বন্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছেন। তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে
মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ।