আকাশ সংস্কৃতির যুগে কিশোরগঞ্জের সিনেমাপ্রেমিরা আজকাল সিনেমা হলে সহসাই পা বাড়ায় না। কষ্ট করে আর গাঁটের পয়সা খরচ করে সিনেমা হলে যায় না তারা। মোবাইলের মেমোরি কার্ড কিংবা অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে চোখের সামনে পেয়ে যায় মনের মতো সিনেমা। অন্যদিকে ভালো গল্প নির্ভর ছবি হলে তৈরি হচ্ছে না বা ক্রিয়েটিভ চিত্র পরিচালকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, যে কারণে ছবির মান খুব খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন এক সময়ে সিনেমা হলে নিয়মিত যাওয়া দর্শকরা। তাদের মন্তব্য, বর্তমানে দেশে যেসব ছবি তৈরি হচ্ছে নানা কারণে ছবিগুলো দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে না। এছাড়াও কিছু কিছু পরিচালকরা গাঁজাখোরি গল্প, হিন্দি ছবি থেকে জোড়াতালি দিয়ে গল্প তৈরি করে ছবি বানান। অন্যদিকে কোভিডের কারণে সারা দেশের চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়, একই চিত্র কিশোরগঞ্জেও।
কয়েক বছর আগেও কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সিনেমা হলে ছিল রমরমা ব্যবসা। নতুন কোনো ছবি এলে নারী-পুরুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো সিনেমা হলগুলোতে। টিকিট কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে কালোবাজারির হাত থেকে মূল্যাতিরিক্ত দামে টিকিট কিনতে হতো! এমনকি প্রেক্ষাগৃহ কাউন্টারে প্রায় প্রতিদিন টিকিট নিতে আসা মানুষজনের মধ্যে ঝুট-ঝামেলার খবর শোনা যেত। ছবি আসার সপ্তাহ খানেক আগেই জানা যেত পরবর্তীতে কী ছবি আসছে। তা নিয়ে মানুষজনের মধ্যে আগাম প্রস্তুতি থাকতো। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের অধিকাংশ সিনেমা হল বন্ধ থাকায় এ জেলার মানুষের আনন্দ বিনোদনের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে রথখলায় ‘মানসী’ সিনেমা হল, বত্রিশে ‘ইউনিভার্সেল টকিজ’ ও গৌরাঙ্গবাজারে ‘রঙমহল’ সিনেমা হল বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে মানসী ও ইউনিভার্সেল টকিজ পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে। আর রঙমহল সিনেমা হল অক্ষত রেখেই, সেখানে মার্কেট বানানো হয়েছে।
করিমগঞ্জ উপজেলায় ছিল তিনটি সিনেমা হল। তার মধ্যে ‘আঁখি’ সিনেমা হল এখন মার্কেট। ‘সংগীতা’ প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে ভাস্কর্য স্থাপন হয়েছে আর নিয়ামতপুরে ‘বিনোদন’ সিনেমা হলটি পরিত্যাক্ত আছে। তাড়াইল উপজেলা সদরে নায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার মালিকাধীন ‘খেয়া’ সিনেমা হল ছিল। ব্যবসায় ধস নামায় তিনি তা বিক্রি করেন স্থানীয় আব্দুল হাই আদুর কাছে। বর্তমানে তাতে তিনি বাসা করেছেন। ‘সৈকত’ সিনেমা হল বর্তমানে হয়েছে একটি কওমি মাদ্রাসা। কটিয়াদিতে ‘মকুল’ সিনেমা হল ভেঙে বাসা-বাড়ি হয়েছে। ‘কথাচিত্র’ সিনেমা হলটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বাজিতপুরে ছিল ‘আলোছায়া’ ও ‘শান্তিমহল’ সিনেমা হল আর একই উপজেলায় সরারচরে ছিল ‘আশা’ সিনেমা হল। আলোছায়া সিনেমা হলের জায়গা কিছুটা পরিত্যাক্ত, আবার অন্যদিকে কিছু দোকানপাট হয়েছে। শান্তিমহল সিনেমা হল এখন অ্যাড. ওসমান গণি মডেল কলেজ। ‘আশা’ পরিত্যক্ত। সরারচরের আরো একটি সিনেমা হল এখন রাইচমিল হয়েছে।
কুলিয়ারচর উপজেলায় রয়েছে ‘আনন্দ’ ও ‘রাজ’ সিনেমা হল। তা মাঝে মাঝে চলে। ভৈরবে ‘দরশন’ ও ‘মধুমতি’ সিনেমা হল চলছে। ‘পলাশ’ সিনেমা হল এখন পরিণত হয়েছে বাসা-বাড়িতে। আর ‘ছবিঘর’ হয়েছে মার্কেট। হোসেনপুরে ‘সখি’ ও ‘সাদমহল’ এখন পরিত্যাক্ত। পাকুন্দিয়ার ‘মৌসুমী’, মঠখলায় ‘শোভন’, পুলের ঘাটে ‘রাখী টকিজ’ ও ‘ফাল্গুনি’ সিনেমা হল বর্তমানে পরিত্যাক্ত অবস্থায়। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলায় আগে থেকেই কোনো সিনেমা হল ছিল না। নিকলীতে একটি সিনেমা হল ছিল তা এখন অডিটোরিয়ামে পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কানন চক্রবর্তী বলেন, ‘আকাশ সংস্কৃতির যুগে দর্শকরা আর হলমুখি হচ্ছে না। দেশের চিত্র পরিচালকরা ভালো গল্পনির্ভর ছবি তৈরি করছেন না। আগে সামাজিক জীবনমুখি এবং গল্পনির্ভর ছবি দেখার জন্য সপরিবারে মানুষজন আসতেন সিনেমা হলে। এখন অকারণে ফাইটিং ছবি তৈরি হচ্ছে যা এক শ্রেণীর দর্শক দেখে। অধিকাংশ দর্শক সিনেমা হলে পা বাড়ান না। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে দর্শক না থাকার কারণে। যে হলগুলো বন্ধ হয়েছে সেগুলো পুনরায় চালু করতে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেয়া দরকার। এছাড়া সিনেমা হল মালিকদের প্রনোদনা ও উৎসাহ দিয়ে হলগুলোকে আধুনিক মানের করতে হবে। চলচ্চিত্র পরিচালকদের ভালো ছবি নির্মাণে সরকারি বাজেট দিতে হবে। আর সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন বা মার্কেট করার প্রবণতা রোধে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’