আফগানিস্তানে
নারীদের জন্য কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার
বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নিয়োগ পাওয়া ৩৪ বছরের চ্যান্সেলর মোহাম্মদ আশরাফ ঘাইরাত এক
টুইট বার্তায় এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি গত ১৫ বছর তালেবানের সাংস্কৃতিক বিষয়াদির
সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
টুইট বার্তায়
আশরাফ ঘাইরাত বলেন, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি
দিচ্ছি, যতদিন না সবার জন্য যথাযথ ইসলামি পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে, ততদিন নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে
আসতে পারবেন না। সবকিছুর আগে ইসলাম।
এর আগে যখন দীর্ঘ
বিরতির পর আফগানিস্তানের সরকারি মাধ্যমিক স্কুল খুলল তখন শুধু ছেলে শিক্ষার্থীরাই সেখানে
যাওয়ার অনুমতি পেল। মেয়েরা কবে স্কুলে যেতে পারবে তা এখনও অনিশ্চিত।
অথচ ক্ষমতা দখলের
পর গত দেড় মাস ধরে তালেবানের ওপর আন্তর্জাতিক মহল থেকে, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছ
থেকে যেসব দাবি-শর্ত দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নারী শিক্ষা এবং তাদের কাজের
অধিকার।
এমনকি যে দেশটির
সমর্থন-স্বীকৃতি তালেবানের জন্য এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
ইমরান খানও কয়েকদিন আগে আফগানিস্তান এবং তালেবান নিয়ে বিবিসিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে
বলেন, নারী শিক্ষা বন্ধ করা অনৈসলামিক হতে পারে। পাকিস্তানের কাছ থেকে তালেবান সরকারের
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি যে শর্তসাপেক্ষ তা তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন।
কিন্তু বাইরের
এসব কথায় আদৌ যে তালেবান কান দিচ্ছে তার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তালেবানের কাছ থেকে জোর
ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের শিক্ষা নিতে হবে
আলাদাভাবে এবং শুধু নারী শিক্ষকরাই তাদের পড়াতে পারবেন। আফগানিস্তান নারী শিক্ষকের
সংখ্যা এতই কম যে, এমনিতেই মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ কমে যেতে বাধ্য।
লন্ডনে আফগান
সাংবাদিক এবং আফগান রাজনীতির বিশ্লেষক সৈয়দ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে
সম্পর্কে আগ্রহ দেখালেও তাদের কথাবার্তা এবং বিভিন্ন শর্ত মানছে না তালেবান। অবশ্য
এর আগেও কখনও অন্যদের কথায় চলেনি তালেবান। নারী শিক্ষা, সঙ্গীত বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার
তরিকা যে বিষয়ই হোক না কেন তারা তাদের পুরোনো বিশ্বাস আর আদর্শ অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছে।
তিনদিন আগে হেরাত
শহরে চারজন সন্দেহভাজন অপহরণকারীকে মেরে তাদের মরদেহ রাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
তার দুদিন আগে বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তালেবানের এক শীর্ষ নেতা চুরি-ডাকাতির
অপরাধে হাত কাটার বিধান চালুর পক্ষে কথা বলেন। অথচ তালেবান জানে দেশ চালানোর জন্য যাদের
সাহায্য এবং স্বীকৃতি তাদের জন্য জরুরি তারা এসব পছন্দ করবে না।
নিজামী বলেন,
কাবুল দখলের আগে বা পরপরই যেসব তালেবান নেতার মুখের কথা শুনে মনে হচ্ছিল গত ২০ বছরে
তাদের চিন্তা-চেতনায় হয়ত বেশ পরিবর্তন হয়েছে, তারা কেউই ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেননি।
যারা এসেছেন তারা তাদের পুরোনো মত-পথ থেকে সরে আসেননি এবং চাপ দিয়ে তাদের নড়ানো কঠিন।
যে দেশটির জিডিপির
৪০ শতাংশই পশ্চিমা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেই সাহায্য গত দেড় মাস ধরে বন্ধ।আফগানিস্তানের
১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্র আটকে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক
এবং আইএমএফ আফগানিস্তানের জন্য তাদের জরুরি ঋণের নির্ধারিত কিস্তি স্থগিত করে দিয়েছে।
আটকে দেওয়া এসব
টাকা এখন তালেবানের ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের
প্রধান অস্ত্র। তারা বলছে, নারীদের শিক্ষা এবং কাজের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী
এবং আফগান সমাজের বিভিন্ন অংশকে ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে।
এমনকি পাকিস্তান,
রাশিয়া, ইরান সহ প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকেও স্বীকৃতি এবং সমর্থনের শর্ত হিসেবে
সরকারে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু এবং নারী প্রতিনিধিত্বের দাবি করা হয়েছে।
কাবুলে বিদেশি,
বিশেষ করে প্রভাবশালী কয়েকটি আঞ্চলিক দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাহায্য ও স্বীকৃতির
বিষয়ে কথা বলতে তালেবান তৎপর। প্রতিদিনই বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক ও কথাবার্তা হচ্ছে।
কিন্তু বিদেশিদের দেওয়া শর্ত নিয়ে তালেবানের কাছ থেকে কোনো কথা বা প্রতিশ্রুতি নেই।
বিশেষ করে সরকারে
কারা থাকবে, কী থাকবে না তা নিয়ে কোনো কথা তালেবান শুনতে চায় না। আমেরিকানদের সমর্থনে
যেসব সরকার ছিল তাদের তালেবান বিশ্বাস করে না। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের
ধারণাই তারা মানে না বলে মনে করেন নিজামী। তাদের কথা, এটি একটি ইসলামি সরকার। এর সাথে
জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নেই।
সরকারে বিভিন্ন
জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সম্প্রতি তাজিকিস্তানের এক বিবৃতিকে কেন্দ্র করে চরম
ক্ষুব্ধ তালেবান। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালেবানের মুখপাত্র আহমেদুল্লাহ ওয়াসিক
বলেন, যে তাজিকিস্তান আমাদের জন্য সমস্যা তৈরিতে ব্যস্ত তারা আমাদের সরকারের কাঠামো
নিয়ে কথা বলার কে? তাদের উচিৎ নিজেদের সমস্যা সমাধান করা। আমাদের সরকার কেমন হবে তা
নিয়ে বিদেশিদের কথা বলার কোনো অধিকার নেই।
কিন্তু স্বীকৃতি
ছাড়া দেশ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থকড়ির সংস্থান কিভাবে করবে তালেবান? আব্দুল্লাহ
নিজামী বলছেন, তালেবান ভরসা করছে আঞ্চলিক কয়েকটি দেশের ওপর অর্থাৎ চীন রাশিয়া, ইরান
এবং পাকিস্তান এবং সেই সঙ্গে কাতার। আফগানিস্তানে নারী অধিকার, নারী শিক্ষা নিয়ে এসব
দেশের তেমন কোনো চিন্তা নেই। তালেবান মনে করে এসব দেশ তাদের কৌশলগত স্বার্থ নিয়েই
বেশি উৎসাহী।
কাবুলের সঙ্গে
গোপনে এবং প্রকাশ্যে আঞ্চলিক কয়েকটি দেশের যোগাযোগ যে চলছে তা স্পষ্ট। সেপ্টেম্বরের
২১ ও ২২ তারিখ কাবুলে ছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের আফগান বিষয়ক দূত জামির কাবুলভ, চীনের
আফগান বিষয়ক বিশেষ দূত উ শাও উং এবং পাকিস্তানের মোহাম্মদ সাদিক খান। তালেবান জানিয়েছে,
এদের তিনজনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তালেবান সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান আখুন্দজাদার।
তবে পাকিস্তান,
চীন এবং রাশিয়া তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্তের
পথ নিয়েছে বলে জোর ইঙ্গিত রয়েছে।
পাকিস্তানের উদ্যোগে
৮ সেপ্টেম্বর চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠক করেছেন। দু'দিন পর শনিবার আবারও পাকিস্তানের উদ্যোগেই
এসব দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা একটি বৈঠক করেন বলে পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য ইংরেজি দৈনিক
ডনের এক খবরে বলা হয়েছে। আমেরিকার সাথেও গোপনে পাকিস্তান কথা বলছে বলে ডনের খবরে বলা
হয়েছে।
তবে নারী শিক্ষা
বা সরকার কাঠামো নিয়ে চীন বা পাকিস্তান তালেবানের সাথে বড় কোনো ঝামেলায় জড়াতে রাজি
হবে বলে মনে হয় না।
যেমন, চীনের বিশেষ
দূত উ শাও উং-এর সঙ্গে কাবুলে তালেবান প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, উ শাও বৈঠকে আবারও আশ্বস্ত করেছেন
যে, চীন আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা গলাবে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
ইমরান খান প্রকাশ্যে নারী শিক্ষা, মানবাধিকার এবং কাবুলে সব পক্ষের একটি সরকারের যত
কথাই বলুন না কেন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো চোট তৈরির ঝুঁকি তিনি নেবেন না।
বরং পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তালেবানকে আফগান সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে
বলে বিবিসি উর্দু ভাষা বিভাগের মঙ্গলবারের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে। উচ্চপদস্থ
সেনা সূত্রকে উদ্ধৃত করে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সামরিক
গোয়েন্দা প্রধান লে. জেনারেল ফায়েজ হামিদের কাবুল সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই প্রস্তাব
নিয়ে তালেবানের সঙ্গে কথা বলা।
তবে আফগানিস্তান
নিয়ে পাকিস্তানসহ সমস্ত প্রতিবেশীর প্রধান উদ্বেগ সন্ত্রাস এবং তা নিয়ে তারা তালেবানের
কাছ থেকে শক্ত প্রতিশ্রুতি চায়।
অপরদিকে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তালেবানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা কতটা কাজ করবে এবং তা হিতে-বিপরীত হয় কিনা তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে মতামত দ্বিধাবিভক্ত। ইউরোপের মাত্র দুটি দেশ ছাড়া কেউই বলেনি তারা তালেবানকে কখনই মেনে নেবে না।