বায়ান্নতে
মর্যাদা পেয়েছিল ভাষা শহীদ দিবস। কিন্তু তার আগে পরেও ভারতবর্ষে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার
দাবিতে হয়েছিল উত্তাল আন্দোলন।
পৃথিবী জুড়ে
যদি একটি বিশেষ ভাষায় কথা মানুষ বলতো, তাহলে হয়তো লড়াই সংগ্রামের প্রয়োজনই পড়তো না।
নানান দেশে রয়েছে নানান ভাষা। আর সে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই বিভিন্ন সময়ে
হয়েছে আন্দোলন সংগ্রাম। কখনো কখনো দাবি আদায়ের প্রশ্নে সহিংসতায় জড়িয়েছে বিশেষ জাতিগোষ্ঠী।
সময়টা ছিল ১৯৪০
থেকে ১৯৫০। এর মধ্যভাগে বাংলা ভাষার দীর্ঘতম আন্দোলন হয় মানভূমে। হিন্দি ভাষায় শিক্ষা
বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল রাজ্যটিতে। কিন্তু ক্ষমতার বাড়াবাড়ি মেনে নেয়নি বাঙালি। বাংলা
ভাষার দাবিতে চলমান আন্দোলন দমাতে মিথ্যা মামলা দিয়ে দমন পীড়ন করে সরকার। চাকরি থেকে
বরখাস্ত করে দিনের পর দিন হয়রানি করা হয় বাঙালিদের।
মানভূমের পাকবিড়া
গাও থেকে কোলকাতা পর্যন্ত ১৬ দিনের পদযাত্রায় শামিল হন হাজারো মানুষ। পরে হিন্দি ভাষার
সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। বাঙালি অধ্যুষিত মানভূম ভেঙ্গে ১৯৬৫ সালে নতুন জেলা
পূরুলিয়া গঠন করতে বাধ্য হয় সরকার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহাবুবুল হক বলেন, “বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে
১৯৫৬ সালে পূর্বতন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলার সদর মহকুমাটি পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গের
অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছিল, সেই হিসেবে পুরুলিয়ার ভাষাও
বাংলা হয়ে যায় এবং এই ভাষা আন্দোলন আর প্রয়োজন হয় না, স্থিতিমিত হয়ে যায়।”
প্রাদেশিক সরকার
অহমীয় বা অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল আসামের মানুষকে। ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে
ফুঁসে ওঠে আসামবাসী। সেখানেও গঠিত হয় গণসংগ্রাম পরিষদ। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন
চলে বেশ কিছুদিন। রেল ব্যবস্থা বন্ধ করায় অচল হয়ে পরেছিল পুরো আসাম। এরপর শুরু হয় দাঙ্গা।
মাঠে নামে আসাম পুলিশ ও আসাম রাইফেলস। গুলি চালায় সাধারণের বুকে। ঘটনাস্থলেই মারা যান
আন্দোলনকারীদের ৯ জন। বুলেট বিদ্ধ ১২ জনের দু’জন প্রাণ হারান হাসপাতালে।
বাংলা ভাষার
দাবিতে আসামে মানুষ হত্যার পর ভারতজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়। শেষতক পিছু হটে রাজ্য সরকার।
অতপর প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা।
ভাষার ইতিহাস
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম বলেন, “বাংলাদেশে যেমন, আসামের ক্ষেত্রে আসলে একই ঘটনা ঘটেছে। সেটা হল- এর সঙ্গে
আসলে পরিচয়ের রাজনীতি জড়িত। দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলা এবং তার বিপরীতে অহমিয়া স্থানীয়
জনগোষ্টি এর অধিকার, আধিপাত্য, পরস্পরের মোকাবেলা এগুলো গভীর ভাবে যুক্ত।”
পৃথক দুটি ঘটনার
মাঝে পূর্ববঙ্গের ভাষা সংগ্রাম যোগ করেছিল ভিন্ন মাত্রা। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা
করে গর্জে উঠেছিল ঢাকার ছাত্র-জনতা। রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় মায়ের ভাষা
বাংলা।
মোহাম্মদ আজম
আরও বলেন, “ভারত যেহেতু বহু ভাষিক দেশ, ফলে ওখানে ছোট ছোট অঞ্চলে যে আন্দোলনগুলো
হয়েছিল সেগুলো ঠিক জাতিয়তাবাদি স্তরে উন্নিত হয়নি।”
বিশ্লেষকদের
অভিমত, ভাষা আন্দোলনের যে চেতনা ছিল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে
গেছে।
মোহাম্মদ আজম
বলেন, “সামগ্রিক ভাবে ভাষার একটা মহিমা আছে। কারণ ভাষা একটা রাজনৈতিক ব্যপার।
ভাষা একটি আর্থিক ব্যপার। আমাদের এখানে এই ব্যাপারটা বাদ ভাষা হয়ে উঠেছে শুধুই জাতিয়তাবাদি
গর্বের অংশ।”