Logo
শিরোনাম

জাগ্রত চৌরঙ্গী

প্রকাশিত:বৃহস্পতিবার ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | হালনাগাদ:মঙ্গলবার ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭৯৫জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

ডান হাতে গ্রেনেড, বাঁ হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরা, খোলা শরীর, দৃপ্ত পায়ে পেশিবহুল মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্যের গল্প উঠলে চোখে ভাসবেই জাগ্রত চৌরঙ্গী। এটিই দেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত ও আহত বীরদের অসামান্য আত্মত্যাগ স্মরণে ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়েছিল জাগ্রত চৌরঙ্গী। ঢাকা আর্ট কলেজের সেই সময়ের অধ্যক্ষ দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর আবদুর রাজ্জাকের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছিল এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম।

তৎকালীন গাজীপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীরবিক্রম ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি বেদিসহ জাগ্রত চৌরঙ্গীর উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। কংক্রিট, গ্রে ও হোয়াইট সিমেন্টের ঢালাইয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটিতে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ সেনা ও মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক সহযোগী হামিদুজ্জামান খানকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে। জাগ্রত চৌরঙ্গীর প্রকৌশলী ছিলেন আবদুর রশিদ, তাঁর দুই সহকারী ছিলেন এম আহমদ ও আবদুল হক। নির্মাণ তত্ত্বাবধানে ছিলেন মো. আসলুল হক ও আবদুল হক। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সুবেদার খন্দকার মতিউর রহমান বীরবিক্রম। নির্মাণকাজে জড়িত সবাই ছিলেন ঢাকা আর্ট কলেজের। আলোকসজ্জার দায়িত্বে ছিল গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর (পরে গাজীপুর) সেনানিবাসের ভাওয়াল রাজবাড়িতে ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যালয়। ২৫-৩০ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানিরা বাঙালি দমনের নীলনকশা অনুযায়ী ১৫ মার্চের মধ্যে রাইফেল জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বাঙালি সেনারা রাজি না হলে ১৯ মার্চ সকালে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিতে জয়দেবপুর সেনানিবাসে আসেন। এ খবর জানাজানি হলে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় জনতা লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে জয়দেবপুর বটতলায় জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই যুদ্ধে মনু খলিফা, ফুটবলার হুরমত আলী ও কানু মিয়া এবং কিশোর নিয়ামত শহীদ হয়। জয়দেবপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে এই সম্মুখযুদ্ধের পর সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সারা দেশে স্লোগান ওঠে, জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো

গাজীপুরের ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯ মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধে শহীদ হুরমত-মনু খলিফাদের স্মৃতি অমর করতে গাজীপুর ক্যান্টনমেন্টের ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীরবিক্রম গাজীপুরে ভাস্কর্য তৈরির উদ্যোগ নেন। ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য তিনি দায়িত্ব দেন ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাককে। ভাস্কর্যটি তৈরিতে ৩০ হাজার ইট, ইটের গুঁড়া, রড এবং প্রায় ৩০০ ব্যাগ সিমেন্ট লাগে। ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ চলে আর্ট কলেজে। কাজ শেষ হলে ক্রেনের সাহায্যে সেটি ট্রাকে তুলে ঢাকা থেকে গাজীপুরে আনা হয়।

ভাস্কর্যটি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়েছেন ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাক। তিনি দিনরাত মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদের বাসায় থেকে কাজ করেছেন। আমীন আহম্মেদ চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে শহীদ হুরমত আলীর মা কদরজানকে দিয়ে ভাস্কর্যের উদ্বোধন করাতে। কিন্তু কদরজান মারা যাওয়ায় তা আর হয়নি। পরে ভাস্কর্যটি আর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি।

গাজীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস ছাত্তার জানান, অতীতে বাসে যাতায়াতের সময় বহুদূর থেকে জাগ্রত চৌরঙ্গী দেখা যেত। ভাস্কর্যটি দেখে যাত্রীরা চান্দনা বাসস্ট্যান্ডে নামত। ভাস্কর্যের হাতের গ্রেনেড ও রাইফেল দেখিয়ে মা-বাবা তাঁদের শিশুসন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানাতেন।

গাজীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার আবদুর রউফ নয়ন বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে অনেক দেশ নানা উদ্যোগ নেয়। সবার ওপরে থাকে বীরদের ইতিহাস ও বীরত্ব নিয়ে ভাস্কর্য। জার্মানি, রাশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে রাস্তা ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের ভাস্কর্য বেশি দেখা যায়। এ ধরনের ভাস্কর্য স্থাপনে আমাদের দেশ এখনো পিছিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য আরো বেশি বেশি স্থাপন করা দরকার।

নিউজ ট্যাগ: জাগ্রত চৌরঙ্গী

আরও খবর