‘আজ ছুটি। কাল রাতে তোমাকে দেখলাম। অনেকদিন পর তোমার কথা মনে
পড়ল। রাগ করোনা ইচ্ছে করেই তোমাকে ভুলে গিয়েছিলাম (এখন সামান্যতম মানসিক দুর্বলতাকে
আমার প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। সাহস আর মানসিক দৃঢ়তাই আমার মূলধন)। আমার ঘরের বাইরে মেঘের
মিছিল। তোমরাও তো এখন বৃষ্টির গান শুনছো, নয় কি? বাংলাদেশের আকাশ-আহা কতদিন দেখিনি।
বাংলার মেঘ, বৃষ্টি বাতাসের সান্নিধ্যে কবে যাব। মা, আমি তোমার কাছে যাব মাগো।’
মায়ের কাছে যাওয়ার এই আকুতি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এক
সন্তানের। যার রক্তের ভেতর ছিল স্বপ্ন আর তার যৌবনের অহংকার দেশপ্রেম। যার কাছে মানুষ
মা ও বাংলা মা দুই এক হয়ে গিয়েছিল। একজনের কথা যিনি আলাদা করে ভাবতেই পারেননি। আর মুক্তি
যুদ্ধে উৎসর্গকৃত প্রাণ এ শহীদের নাম কাজি নুরুন্নবী। যুদ্ধদিনে তিনি নিয়মিত ডায়েরি
লিখতেন। মায়ের কাছে লেখা এ চিঠি ডায়েরির অংশ।
টগবগে এই তরুণের ১৯৭০-৭১ এ লেখা ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাজি নুরুন্নবীর ডায়েরি’ নামে এ সংকলনটি কাজী ইসলামের সম্পাদনায়
কয়েক বছর আগে ঢাকার অয়ন প্রকাশনীর পক্ষে মিঠু কবির প্রকাশ করেন।
সংকলনটি থেকে জানা যায়, কাজি নুরুন্নবী রাজশাহী মেডিকেল কলেজে
শেষ বর্ষে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের
নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রথমে ইপিআর এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে
অংশ নেন। রাজশাহী পতনের পর ভারতের বালুরঘাটের বাঙালিপুর যুবক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান
থেকে টান্ডুরায় জেনারেল উবানের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব বাহিনীর
রাজশাহী বিভাগের লিডার নির্বাচিত হন। একাত্তরের ১ অক্টোবর রাজশাহীতে পাকিস্তানী বাহিনীর
হাতে ধৃত হয়ে নিখোঁজ হন তিনি।
নুরুন্নবী নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। রাজশাহীর পতনের সময় রাজশাহী
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত একজন মেল নার্সের কাছে ‘৭০-৭১ এর ডায়েরি দু’টি রেখ যান। যুদ্ধের পর কোন এক সজ্জন ব্যক্তি
ডায়েরি দু’টি
নুরুন্নবীর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। মাকে লেখা এ চিঠিটি ডায়েরি ’৭১ এ লেখা।
কাজি নুরুন্নবী মাকে লেখা চিঠিতে আরো লিখেন, ভাবছিলাম বেশ
বদলে গেছি। আজ দেখছি মোটেও তা নয়। আজ মনে হচ্ছে কতদিন কবিতা পড়িনি। কেমন করে আছি, অথচ
আছি। এখন যদিও আমি দিন রাত যুদ্ধের কথা ভাবি, অস্ত্রের কথা ভাবি, ভাবি পাকিস্তানীদের
কেমন করে খুন করবো, কিন্তু দেখছি সবার পাশে কবিতার কথা ভাবছি। তোমার কথা ভাবছি। আসবার
সময় আমার মায়ের চোখে জল দেখেছিলাম। কিন্তু বাবার চোখে বিদ্যুৎ দেখেছিলাম। জানো, আসবার
সময় অসুস্থ শরীরেও বাবা আমাদের দুই ভাইকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। তখনো বাবা
আমার হেসেছেন। মাঝে মাঝে ভাবনা হয়, ওদের কি দেখতে পাব। কিন্তু আমাদের দুঃখ করতে নেই।
মন খারাপ করতে নেই।
একাত্তরের মার্চ মাসের ২৭ তারিখ নুরুন্নবী শেষ তার মাকে দেখেছিলেন।
এ নিয়ে চিঠিতে লিখেন , ২৭/৩ বোধ হয় তোমাকে দেখেছিলাম, তাই না? এই তিন মাসে কত কি হয়ে
গেলো। আমি মানুষটাও কত বদলে গেলাম। এখন কিন্তু মনে হয় মায়ের যোগ্য সন্তান হয়েছি (মানুষ
মায়ের ও বাংলা মায়েরও)। আসলে দুই মা আমার কাছে এক হয়ে গিয়েছে। একজনের কথা আলাদা করে
ভাবতেই পারি না। তোমার যোগ্য হয়েছি কিনা সেটা সম্বন্ধে আমি সন্দিহান। সেটা বোধ হয় আর
হতে পারব না। ইচ্ছাকৃতভাবে যে জীবন আামি বেছে নিয়েছি তা থেকে মুক্তি আমার নেই। তা আমি
চাইও না। যতদিন না আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি তত দিনেই। মৃত্যু ছাড়া আমি সরবো না।
‘সৈনিক হতে চাইতাম, তোমাকে বলতাম প্রায়ই, মনে পড়ে? সে সৈনিক
আমি হয়েছি নিজের দেশের সৈনিক। মায়ের ঋণ শোধের একমাত্র পথ, আসলে ঋণ শোধ তো সম্ভব নয়,
বলতে পার মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের একমাত্র পথ। সেই সুযোগ আমি পেয়েছি। একি ছাড়া যায়?
মায়ের জন্য রক্ত দেয়ার এ মহা সুযোগ কি কোন সন্তান ছাড়তে পারে’-লিখেন নুরুন্নবী।
চিঠিটা শেষ হয় মায়ের কাছে যাওয়ার তীব্র আকুতি নিয়ে। নুরুন্নবী
লিখেন, ট্রেনিং প্রায় শেষ। ব্যস্ততার ঘাটতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দিবাবসানের সময়। ছাত্রজীবনেও
এত মনযোগী সিনসিয়ার হতে পারিনি। অথচ এখানে আমার কাজে আমিই অবাক হয়ে গেছি। তবুও, মনে
হয়, সব শেখা হলো না। জানার বাদ থেকে গেলো। মা, আমি তোমার কাছে যাব মাগো।
নুরুন্নবীর মায়ের কাছে আর ফেরা হয়নি। সামিল হতে পারেননি একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী মানুষের মিছিলে। কি করে পারবেন? সম্প্রতি প্রয়াত লেখক এবং সাংবাদিক
রাহাত খান না পারা নিয়ে লিখেছেন, যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় নুরুন্নবী ভাবতেন ‘দেশ স্বাধীন হবেই।’ পরক্ষণেই তার মনে হয়েছে ‘উন্নত শির সেই মানুষের মিছিলে তিনি হয়তো
যেতে পারবেন না। দুঃখ নেই।’
নুরুন্নবীর কথা সত্য হয়েছে। দেশ বিজয় অর্জন করেছে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। নুরুন্নবী শহীদ হন অক্টোবরে। স্বাধীনতার মিছিলে তিনি যোগ দিতে পারেন নি। কী করে পারবেন? তার রক্তে স্রোত হয়েই তো স্বাধীনতা এসেছে। সূত্র: বাসস