আমরা এমন অনেক
সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখি যার পটভূমিকা মূলত কোনও ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তার
মধ্যে বেশ কিছু সত্যিকারের ঘটনা অবলম্বনে হয়। আবার বেশ কিছু ঘটনা নিছকই কাল্পনিক এবং
সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র। যেমন ‘ধুম-২’ সিনেমায় হৃত্বিক রোশনের ডাকাতির ঘটনাগুলি
বা হালের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মানি হেইস্ট’-এ ডাকাতির ঘটনাগুলি দর্শকদের মধ্যে টান-টান
উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
তবে বিশ্বের ইতিহাসে
এমন কিছু ডাকাতির ঘটনা রয়েছে, যা হার মানাবে সিনেমার গল্পকেও। এই ডাকাতির ঘটনাগুলি
নাড়িয়ে দিয়েছিল সারা বিশ্বকে।
এ রকমই এক ডাকাতির
ঘটনা ‘৩০০ মিলিয়ন ইয়েন
ডাকাতি’। ৩০ কোটি ইয়েনের এই ডাকাতি জাপানের ইতিহাসে
ঘটা অন্যতম বড় ডাকাতি। এই ডাকাতির ঘটনায় যুক্ত ছিলেন মাত্র এক জন।
১৯৬৮ সালের ১০
ডিসেম্বর জাপানের টোকিয়ো শহরে এই ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ অফিসারের ভুয়ো পরিচয় নিয়ে
মোটরবাইকে চেপে আসা এক ব্যক্তি একাই এই ডাকাতি করেন এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
১৯৬৮ সালের ১০
ডিসেম্বরের সকালে নিপ্পন ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের কোকুবুঞ্জি শাখার চার জন কর্মচারী ব্যাঙ্কের
গাড়িতে ২৯৪,৩০৭,৫০০ ইয়েন অর্থাত্ প্রায় ৩০ কোটি ইয়েন নিয়ে যাচ্ছিল। এই গাড়ির ভিতরে
তোশিবার ফুচু কারখানার কর্মীদের বোনাসের টাকা ছিল।
টোকিয়ো ফুচু কারাগারের
পাশের রাস্তায় মোটরসাইকেলে আসা জাপানি পুলিশের উর্দি পরিহিত এক জন যুবক এই গাড়িটি
থামিয়ে দেন। গাড়িটি তখন গন্তব্য থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছিল।
পুলিশের উর্দি
পরিহিত এই যুবক ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের জানান, তাঁদের শাখার ম্যানেজারের বাড়িতে বিস্ফোরণ
হয়েছে। পুলিশ একটি সতর্কবার্তা পেয়েছে যে, তাঁদের গাড়িতেও ডিনামাইট লাগানো আছে।
ব্যাঙ্কের কর্মীরা
ওই যুবককে পুলিশ বলে বিশ্বাস করে নেন। কারণ তার কিছু দিন আগে সত্যিই ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে
হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
বোমা শনাক্ত করার
নাম করে ওই যুবক হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির নীচে যান এবং কর্মচারীদের গাড়ি থেকে বের করে
দেন।
কিছু ক্ষণ পরে,
কর্মীরা গাড়ির নীচে ধোঁয়া এবং আগুনের শিখা লক্ষ্য করেন। এর পরই এই যুবক গাড়ির নীচ
থেকে বেরিয়ে আসেন এবং গাড়িতে বিস্ফোরণ হতে চলেছে বলে চিৎকার করতে থাকেন। ভয়ে কর্মচারীরা
পিছু হটলে ওই যুবক গাড়িতে চেপে পালিয়ে যান।
গাড়ি করে কিছুটা
এগিয়ে ওই যুবক ব্যাঙ্কের গাড়ি ছেড়ে দেন এবং আগে চুরি করা অন্য একটি গাড়িতে টাকার
বাক্সগুলি চাপান। এর পর আরও কিছুটা এগিয়ে তিনি অন্য একটি গাড়িতে চেপে পালিয়ে যান।
তদন্তে নেমে পুলিশ
ঘটনাস্থল থেকে অনেক তথ্যপ্রমাণ উদ্ধার করে। এই ঘটনায় ১৯ বছর বয়সি এক যুবককে অভিযুক্ত
হিসাবে চিহ্নিত করে পুলিশ। কিন্তু তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি
নিজেও এক পুলিশকর্মীর ছেলে ছিলেন।
কিন্তু তাঁর মৃত্যুর
পরও লুঠ হওয়া টাকার কোনও হদিশ মেলেনি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ না মেলায় পরে তাঁর
উপর থেকে অভিযুক্ত তকমা ঘোচে।
এর পর আরও তত্পর
হয় পুলিশ। সেই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে দাবি করা হয়, এই ঘটনার তদন্তে নামে প্রায় এক
লক্ষ ৭০ হাজার পুলিশ। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় নাম ওঠে প্রায় এক লক্ষ ১০ হাজার ব্যক্তির!
জাপানের ইতিহাসে এটিকেই সব থেকে বড় পুলিশি তদন্ত বলে মনে করা হয়।
১৯৬৯ সালে ১২
ডিসেম্বর অন্য এক ২৬ বছর বয়সি যুবককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাঁকেও
ছাড়তে বাধ্য হয় পুলিশ। মিথ্যে প্রমাণ জোগাড় করে তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য এক পুলিশ
অফিসারকে বরখাস্তও করা হয়।
১৯৭৫ সালে, পটাসিয়াম
সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করা যুবকের এক বন্ধুকে বিপুল পরিমাণ টাকার-সহ গ্রেফতার করা
হয়। ডাকাতির ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮। তাঁর কাছে এত টাকা কোথা থেকে এল তার কোনও সদুত্তর
দিতে পারেননি তিনি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধেও প্রমাণ জোগাড় করতে অক্ষম হয় পুলিশ।
সাত বছর তদন্ত
চালিয়ে অবশেষে হাল ছাড়ে পুলিশ। আজ পর্যন্ত অধরা অপরাধী। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জাপানে
সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজও বানানো হয়েছে।
তবে এ ঘটনাকে
ডাকাতি বলে কখনও মেনে নেয়নি জাপান। জাপানের ফৌজদারি আইনের অধীনে ডাকাতির পরিবর্তে এটিকে
সাধারণ চুরি হিসাবে ধরা হয়।