উন্নত জীবনের
আশায় ইউরোপের পথে পা বাড়িয়ে মানব পাচারের শিকার হয়েছে মাদারীপুরের অর্ধশতাধিক যুবক।
এদের মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। এসব পরিবারে চলছে মাতম। মাদারীপুরের ঘরে ঘরে কান্নার
রোল। সম্প্রতি পাচারের শিকার ৫৭ পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের উদ্ধার ও দালালদের বিচার
দাবিতে মানববন্ধন করা হয়েছে।
এদিকে গত দুই
তিন ধরে পাচারের শিকার পাঁচ যুবকের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এক মিনিট সাত সেকেন্ডের
ওই ভিডিওতে দেখা যায় পাঁচ যুবক একটি ঘরে বন্দী। ভিডিওতে তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে উদ্ধারের
আকুতি জানিয়ে বলেন, গত ১৫ দিন ধরে রোমানিয়ার একটি ঘরে আমাদের আটকে রেখেছে। ঠিকমতো খাবারও
দেয় না। আমরা বাঁচতে চাই, আমাদের বাঁচান। দালাল শামিম ও আল আমিনের কাছে টাকা দিয়েছে
বলেও দাবি করেন ভিডিওতে।
অনুসন্ধান করে
জানা গেছে, রোমানিয়ায় বন্দীরা হলেন, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর গ্রামের মিলন মিয়া
ও মস্তফাপুর ইউনিয়নের সিকি নওহাটা গ্রামের মোফাজ্জেল হাওলাদার এবং ডাসার উপজেলার বালিগ্রামের
মৃত সৈয়দ সালামের ছেলে তানভীর এবং একই গ্রামের সাঈদ হাওলাদারের ছেলে বায়েজিদ হাওলাদার
ও রাশেদ হাওলাদার।
বন্দীদের পরিবারের
দাবি, রোমানিয়া থেকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে কয়েক লাখ
টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। বর্তমানে রোমানিয়ার অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে পরিবারের কাছে
ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে আরও টাকা দাবি করছে। এই ঘটনায় অভিযোগ পেয়ে দালাল চক্রের একজনকে
গ্রেফতার করেছে মাদারীপুর সদর থানা পুলিশ।
ভুক্তভোগী পরিবারের
অভিযোগ, এই দালাল চক্রের হাতেই বসনিয়ায় বন্দী রয়েছে মাদারীপুরের আরও পাঁচ যুবক। বৃহস্পতিবার
বিকালে ভুক্তভোগী পরিবার থানায় অভিযোগ দিলে সেদিনই চক্রের একজনকে আটক করে পুলিশ। আটক
আল আমিন (২৯) মাদারীপুর সদর উপজেলার হাজির হাওলা এলাকার জাফর বেপারীর ছেলে। অভিযোগ
রয়েছে আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী পরিবারের
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর সদর হাজির হাওলা এলাকার জাফর বেপারীর ছেলে আল আমিন
(২৯), রাস্তি এলাকার শামিম আকন ও তার স্ত্রী সুমি বেগম (২৮), সিরাজ আকন (৬০), হাজির
হাওলা এলাকার জাফর বেপারী ও তার স্ত্রী রীনা বেগম, সিরাজ আকনের স্ত্রী রানু বেগম। তারা
সবাই একই দালাল চক্রের সদস্য। রোমানিয়ায় অবস্থানরত স্বজনদের মাধ্যমে ইতালিতে পৌঁছে
দেওয়া এবং উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে চলতি বছরের ৩ আগস্ট ভুক্তভোগী পাঁচজনের পরিবারের
কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নেয়।
এক মাসের মধ্যে
ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা কালক্ষেপণ করতে থাকে। বর্তমানে ওই পাঁচ যুবককে
১৫ দিন ধরে রোমানিয়ায় আটকে রেখে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে চক্রের সদস্যরা। ভুক্তভোগী পরিবার
থানায় অভিযোগ করলে দালাল চক্রের সদস্য আল আমিনকে আটক করে। ভুক্তভোগী পরিবার জানায়,
তাদের মাধ্যমে ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গিয়ে মাদারীপুরের আরও পাঁচজন অনেকদিন ধরে বসনিয়ায়
রয়েছে।
রোমানিয়ায় বন্দী
থাকা তানভীরের ভাই মো. সৈয়দ সেলিম জানান, রোমানিয়া থেকে ইতালিতে পাঠাতে গ্রিসে অবস্থানরত
শাহিনের সঙ্গে চুক্তি করে তার ভাগনে আল আমিন ও তার স্ত্রী সুমিসহ সবাইকে উপস্থিত রেখে
পাঁচ পরিবার তাদের ৮ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা দেই। কিন্তু তারা আমার ভাইসহ অন্যদের
ইতালিতে না নিয়ে রোমানিয়ায় আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করছে। আমরা ভাইসহ সবার মুক্তি চাই
এবং দোষীদের বিচার চাই।
এদিকে গত ২০ নভেম্বর
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ায় ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে মাদারীপুর সদর উপজেলার
পশ্চিম খাগদী এলাকার আবুল কালাম খানের ছেলে সাব্বির খান ও বড়াইলবাড়ি গ্রামের হাবিবুর
রহমান তালুকদারের ছেলে সাকিবুল। নিহতের স্বজনরা জানান, চরনাচনা গ্রামের দালাল চক্রের
সক্রিয় সদস্য সেকেন মোড়লের ছেলে আতিবর ও কাশেম এবং পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ী গ্রামের
কবির মীরার ছেলে সবুজ মীরা ও তার স্ত্রী মাহমুদা ইতালি নেওয়ার কথা বলে নিহতদের পরিবারের
কাছ থেকে ১০ লাখ করে টাকা নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
এক নিহতের পরিবার জানায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের এক
প্রভাবশালী নেতা মোটা অংকের টাকার বিনিময় ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করছেন। নিহতের
ঘটনায় থানায় মামলা না দিতেও হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ।
এছাড়া মাদারীপুর
সদর উপজেলার মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের হাকিম তালুকদারের ছেলে রুবেল তালুকদার, তোতা তালুকদারের
ছেলে তরিকুল ইসলাম, জুলহাস বেপারীর ছেলে আসাদ বেপারী, মির্জন মোল্লার ছেলে এলাহী মোল্লা,
রাজৈরের বৈলগ্রামের সামিউল শেখসহ অর্ধশতাধিক যুবক পাচারের শিকার হয়েছে।
পাচারের শিকার
রুবেলের মা শাহনা বেগম বলেন, আমার ছেলের খোঁজখবর নেই অনেক দিন। সে বেঁচে আছে নাকি
মারা গেছে তাও জানি না। আমরা চাই আমার ছেলেসহ নিখোঁজ সবার সন্ধান। মাদারীপুরের পুলিশ
সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আমরা মানবপাচারের ঘটনায় একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি।
অভিযোগ পাওয়ার পরই মাদারীপুর সদর থানা পুলিশ একজনকে আটক করেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত করে যেই দোষী প্রমাণ হবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।