Logo
শিরোনাম

মটকাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল শুঁটকি শিল্প

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ৩১ মে ২০২২ | হালনাগাদ:রবিবার ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ২৪৬০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কমে আসায় 'মটকা'র নাম উঠে যেতে পারত হারিয়ে যাওয়া কারুশিল্পের তালিকায়। কিন্তু প্রাচীন এক বাঙালি খাবারের কারণে তা আর হয়নি। চাল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বড়, নাশপাতি আকারের মাটির পাত্রটি বিখ্যাত চেপা শুঁটকি তৈরির জন্যও অপরিহার্য। মটকায় রেখে মাছ গাঁজিয়ে তৈরি করতে হয় চেপা শুঁটকি। এই চেপা শুঁটকি শিল্পের কারণেই শেরপুর জেলার সুভাষ চন্দ্র পাল কুমার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে যেতে পারছেন।

মাটির পাত্রের চাহিদা কেবল নির্দিষ্ট মৌসুমেই থাকে। এ কারণে কুমাররা মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে তেমন আয় করতে পারে না। সুভাষের মতো অন্য কুমাররা পিক সিজনে (নভেম্বর-মার্চ) পুঁজির অভাবে হিমশিম খাচ্ছিলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলে যায় তিন বছর আগে, সুভাষ ও আরও কয়েকজন কুমার ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার একটি মটকা কারখানায় চাকরি পাওয়ার পর।

ওই কারখানায় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হয় কুমারদের। বিনিময়ে থাকা, খাওয়া এবং মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পান। সুভাষের মতো কর্মীরা এখানে কাজ করে স্থির আয়ের পাশাপাশি কিছু সঞ্চয়ের সুযোগও পেয়েছেন। প্রয়োজনীয় রসদ ও উপকরণযেমন জায়গা, ভাটা ও মাটি থাকায় কুমাররা এই মটকাগুলো ব্যাপকভাবে উৎপাদন করতে পারেন। ২০১৮ সালে কুমোর অজিত পাল তার ভাই দিলীপ পাল ও ভাতিজা জয়ন্ত পালকে নিয়ে হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া সড়ক-সংলগ্ন দুই একর জমিতে মটকা তৈরির কারখানা খোলেন। তাদের কারখানা একটি অনন্য প্রয়োজন মেটায়। চেপা শুঁটকি নামক এক বিশেষ জাতের মাছ গাঁজানোর জন্য উত্তর-পুবের হাওর অঞ্চলজুড়ে মটকার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব মটকা তৈরি হয় চেপা শুঁটকি উৎপাদনকারীদের জন্য। অজিত বলেন, 'সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহের জেলেদের জন্য মটকা একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।'

কারখানায় একদিন

মটকা উৎপাদন কারখানাটিতে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২। কারখানার চারদিকে ধানখেত। কারখানায় তিনটি ভাটা এবং খড় ও বাঁশ দিয়ে তৈরি তিনটি বড় চালা রয়েছে। কারখানায় গেলেই চোখে পড়বে আগুনে পোড়ানো মটকা এবং কাঁচা মাটির স্তূপ। চালার নিচে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন শ্রমিকেরা। তাদের খাবার তালিকায় ছিল ভাত, ফলি মাছ, মসুর ডাল ও কুমড়া। তারা জানালেন, কারখানার মাটি সংগ্রহ করা হয় খানিক দূরের আকনপাড়া নামে একটি গ্রামের এক ধানখেত থেকে।  দুপুরের খাবার সেরেই কাজে লেগে গেলেন শ্রমিকরা। অনির পাল নামে একজন কুমোর ছাইয়ের সঙ্গে কাদামাটি মেশানো শুরু করলেন। এটি দিয়ে লেই তৈরি হবে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে লেইয়ের ওজন দাঁড়াবে সাত থেকে আট কেজি। এরপরে পরদিন ব্যবহারের জন্য সেই লেই তারপুলিনের নিচে সংরক্ষণ করা হয়। সেদিনের মটকা তৈরির জন্য সুভাষ আগেরদিন তৈরি লেই বের করে আনলেন। রুটির লেই তৈরি করার মতোই সুভাষ মাটিতে ছাই ছিটিয়ে তার উপর লেই রাখলেন, যাতে সেটি পা দিয়ে চ্যাপ্টা কর যায়।

লেই সমতল হয়ে যাবার পর উৎপাদনের পরের ধাপে যাওয়া হয়। এই ধাপে একে একটি ডিম্বাকার ছাঁচের ওপর স্থাপন করা হয়। সুভাষ ছাঁচের চারপাশে ময়দা ছড়িয়ে দিলেন। তারপর এর ওপরে একটি ছোট বৃত্ত কাটলেন। এরপরে তিনি একটি ভেজা তোয়ালে ব্যবহার করে হাত দিয়ে মটকার গলার আকার দেন এবং গোলাকার আকৃতি বানাতে ছাঁচের চারপাশে হাঁটতে থাকেন।

অনীর বলেন, মটকাকে যে আকার দিতে অর্জন চান, তার ভালো ছবি মনের মধ্যে থাকতে হবে। ছবিটা মনের মধ্যে থাকলে, এ কাজে অনায়াসে করা যায়।

একইভাবে মটকার নিচের অংশ বানানো শেষ করে রোদে শুকালেন সুভাষ। এরপর আরও খানিকটা কাদা আঠার মতো ব্যবহার করে উপর ও নিচের অংশ দুটি জোড়া লাগিয়ে দিলেন। আগুনে পোড়ানোর আগে মটকাগুলো আরেকবার রোদে শুকানো হয়। আধশুকনো মকটাগুলো ভাটার চারপাশে একের পর এক উল্লম্বভাবে রাখা হয়। জ্বালানি কাঠ রাখার জন্য ভাটাগুলোর ভেতরে ফাঁকা জায়গা রয়েছে। রাত ৮টার দিকে শ্রমিকরা ভাটায় আগুন ধরিয়ে দেন। প্রথমদিকে আগুন ধীরে ধীরে জ্বলে, কিছুক্ষণ পরে ধানের তুষ যোগ করে আগুনের আঁচ বাড়ানো হয়। ভোর ৩টা পর্যন্ত ভাটায় আগুন জ্বেলে মটকা পোড়ানো হয়। 'সকালের মধ্যে আগুনে পোড়ানো মটকাগুলো প্রস্তুত হয়ে যায়। কিছু অবশ্য ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। একেকটি মটকা সাধারণত দৈর্ঘ্যে ৩০ ইঞ্চি হয়। ঘাড়ের ব্যাস হয় সাত ইঞ্চি, আর মাঝখানের অংশ বা উদর হয় ২৪ ইঞ্চি চওড়া।

কারখানার মালিদের অজিত জানালেন, তাদের কারখানার মাসিক উৎপাদনক্ষমতা ৫ হাজার মটকা। প্রতি পিস মটকা তিনি ২৪০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করেন। মটকা উৎপাদন ব্যবসা কেবল উপযুক্ত মাটি ও দক্ষ কুমারের পাওয়ার উপরই নির্ভর করে না, বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপরও এই ব্যবসা নির্ভরশীল। যদিও উৎপাদনের প্রকৃত মেকানিকসের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত মাছের উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে মটকা বিক্রির সুযোগও।

শুঁটকি শিল্পে যেভাবে মটকা ব্যবহার করা হয়

প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়া বিশেষ জটিল নয়, তবে সম্পন্ন করতে বেশ সময় নেয়। শুঁটকি তৈরির ফর্মুলা এরকম। একটি মটকায় মাছের তেলে লেপে দিয়ে এক সপ্তাহ রোদে শুকানো হয়। আধা-শুকনো মাছ দিয়ে মটকা ভরার আগে, তেল-লেপা পাত্রে তার দৈর্ঘ্যের দুই-তৃতীয়াংশ মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। তারপর মটকার ভেতরে স্তরে স্তরে স্তূপ করা হয় শুঁটকি মাছ। মটকা ভরা হয়ে গেলে মাছের আঁশের শুকনো গুঁড়া থেকে তৈরি পেস্ট দিয়ে এর গলা সিল করে দেওয়া হয়। আর মটকার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয় কাদামাটি দিয়ে। এরপর গাঁজানোর জন্য মাটকাগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়। কয়েক মাস পর মাটকাগুলোকে মাটি থেকে বের করে ছায়ায় রাখা হয় পরিপক্ব হওয়ার জন্য। অজিত জানালেন, পরিপক্ব হতে সাধারণত চার থেকে ছয় মাস লাগে। তবে এই সময়কাল এক বছর পর্যন্তও বাড়ানো যায়।

বিপন্ন পেশার জন্য নতুন আশার আলো

প্লাস্টিকপণ্য অত্যন্ত সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় কলস ও ধামার মতো মাটির পাত্রের বিক্রি দ্রুত কমছে। ফলে মৃৎশিল্পের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে অনেকে। এমনকি যারা এখনও এ পেশায় আছেন, তারাও তাদের সন্তানদের মৃৎশিল্পের দক্ষতা শেখাতে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এই পেশায় নিয়ে আসতে আগ্রহী না। মৃৎপাত্র তৈরিতে কঠোর শ্রম দিতে হয়, কিন্তু সেই তুলনায় বিনিময়ে বলতে গেলে কিছুই পাওয়া যায় না। অজিত ও তার অংশীদাররা তাদের পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার আশায় কারখানাটি চালু করেছেন। অজিত বলেন, 'মৃৎশিল্পের কাজ থেকে মোটামুটি ভদ্রস্থ আয় করাকে অসম্ভবই মনে হয়েছিল। তাই আমরা ভাবলাম ব্যাপকভাবে মটকা উৎপাদন করলে হয়তো আমাদের এই জ্ঞান ও দক্ষতা টিকে থাকতে পারবে।'

তাদের ধারণা ঠিক হয়েছে। মটকা উৎপাদন ব্যবসায় তারা সাফল্য পেয়েছেন। তাদের পথ ধরে এ ব্যবসায় আসছেন আরও অনেকে। হালুয়াঘাটের কারখানা সফল হওয়ার পর ময়মনসিংহ ও ভৈরব এলাকায় মটকা তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা খোলা হয়। সুভাষও নিজের মটকা কারখানা খোলার জন্য টাকা জমাচ্ছেন। তিনি বলেন, 'আশা করি একদিন আমার নিজের কারখানা খুলতে পারব।' তার বিশ্বাস, যতদিন চেপা শুঁটকির বাজার থাকবে, ততদিন মটকার চাহিদা থাকবে।


আরও খবর

আঙ্গুল ফোটানো কি খারাপ?

শনিবার ০২ জুলাই 2০২2