সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি গ্রহণ ও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তাদের। গতকাল বুধবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের প্রতিনিধিদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে পিডিবির লোকসান হয় কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিদ্যুৎ পাওয়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এ জন্য সরকারকে কিছুটা দায় নিতে হয়। সঙ্গত কারণেই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে পিডিবিকে ঋণের অর্থ ও সুদ দুটি পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিলে তা পরিশোধ করতে হয় না। এটি আমাদের জন্য সুবিধাজনক।
এ দিকে এলসির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি রফতানি বাড়াতে নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সংস্থাটি তাও জানতে চায়।
গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠকে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ বিষয়গুলো বলেছেন।
উল্লেখ্য, আমদানি রাশ টেনে ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েক মাস ধরে এলসি খোলার ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপে করেছে। তারা বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
ঢাকায় সফররত আইএমএফ মিশন প্রধান রাহুল আনাদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি বৈঠকটি করেছেন সিনিয়র বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষসহ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে। আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত মিশনটি ধারাবাহিক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সাথে বৈঠক করবে।
আইএমএফ জানতে চায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কী করছে। জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বলেছে ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও শ্রীলঙ্কার সাথে এফটিএ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামীতে নেপালের সাথে হতে পারে।
ওই বৈঠকে রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখীকরণ পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানোর পর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি বাংলাদেশের কী রয়েছে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের রফতানি বাজার ও পণ্য রফতানি নিয়ে প্রস্তুতি কী সে বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে রফতানি বাস্কেটে আরো পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার।
ট্যারিফ হার যৌক্তিককরণ করার পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাওয়া হয়। বিপরীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা ট্যারিফ পলিসি প্রণয়ন করছি। এ ছাড়া যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে আরোপিত কাস্টম শুল্ক ডব্লিউটিও’র বন্ড ডিউটি হার সীমা অতিক্রম করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক হার ওই সীমার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। পাশাপাশি মিনিমাম ইমপোর্ট প্রাইজ ব্যবস্থা, ডব্লিউটিও এগ্রিমেন্ট অন কাস্টম ভ্যালুয়েশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সে কারণে আলোচ্য মিনিমাম ইমপোর্ট প্রাইসকে পর্যায়ক্রমে ফেইজ-আউট করা হবে। পর্যায়ক্রমে আমদানিপর্যায়ে প্রযোজ্য প্যারা-ট্যারিফ এবং সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হবে।
ব্যবসা সহজীকরণ করার বিষয়ে জানতে চায় সংস্থাটি। ট্যারিফ যৌক্তিককরণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে আরো জোরদার করা হচ্ছে।
ভর্তুকি ও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে প্রশ্ন : সরকার ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে পিডিবি কী করবে আইএমএফ প্রতিনিধি দল জানতে চাইলে পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তখন পিডিবি সরকারের নীতি মেনেই কাজ করবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার প্রতিবছর বাজেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ রাখে। ভর্তুকি হিসাবে এই অর্থ পিডিবিকে দেয়া হয়। যদিও অর্থ বিভাগ বরাবরই বলে থাকে দুই শতাংশ সুদে এটি পিডিবির জন্য ঋণ সহায়তা। কিন্তু কোনো দিনই পিডিবি এই অর্থ ফেরত দেয় না।
আইএমএফের প্রতিনিধিদল জানতে চায়, ২০৩০ সালের পর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট আর পরিশোধ করতে হবে কি না? এই প্রশ্নে পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা এখনো বিষয়টি পর্যালোচনা করেনি। বেশ কয়েকটি নতুন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে। এখনই ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া হিসাবে বিদ্যুৎ গ্রহণ না করেই এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়।
এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি কেন্দ্রকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতেও থাকছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে টাকা ব্যয়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের এক হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) আরো তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটি নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে।
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় এখন কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। কেন্দ্রটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলেও গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ চলতি বছরের ডিসেম্বরেও শেষ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই কেন্দ্র থেকে পুরো বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াই আরো ছয় মাসের বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। বাকি আটটিকে আগের নিয়মে ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে।
ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশে রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপের নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সাথে চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে আদানি গ্রুপকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা দিতে হবে।
সম্প্রতি আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এই সহায়তা চাওয়ার পর আইএমএফ অর্থনৈতিক নানা খাতে সংস্কারের কথা বলছে। বিশেষ করে বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমাতে বলছে প্রতিষ্ঠানটি।
মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে।
বৈঠকে পিডিবি চেয়ারম্যান ছাড়াও পিডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। পিডিবি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।