ঢাকায় কারখানা স্থাপনের সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় ২০০০ সালের পর থেকে তা স্থানান্তরিত হতে শুরু করে আশপাশের এলাকাগুলোয়। বিশেষ করে গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বিস্তৃত হতে থাকে পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। জেলার কোনাবাড়ী-কাশিমপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে অধিকাংশ পোশাক কারখানা। সেসব কারখানা ঘিরে গড়ে উঠেছে আনুষঙ্গিক অন্য নানা স্থাপনাও। তথ্য বলছে, অর্থনৈতিক তত্পরতা বাড়ায় এ অঞ্চলের মানুষের আয় বেড়েছে। তবে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে দূষণ-দখলে মলিন হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ী-কাশিমপুর এলাকায় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৩ হাজার। আর তিন দশকের ব্যবধানে এ এলাকার জনসংখ্যা বর্তমানে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। শিল্পায়ন, বিশেষ করে পোশাক কারখানা ঘিরে এ অঞ্চলের কর্মতত্পরতা বাড়লেও বাড়েনি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। জানা গেছে, ২০১৩ সালে গাজীপুরকে সিটি করপোরেশন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের জানুয়ারিতে সাবেক টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, বাসন, পুবাইল, গাছা ও কাউলতিয়া ইউনিয়ন ভেঙে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। তবে সিটি করপোরেশন হিসেবে গড়ে উঠলেও সে অনুযায়ী নিশ্চিত করা হয়নি নাগরিক সুবিধা। শিল্পায়ন বাড়লেও গড়ে ওঠেনি দূষণ রোধের কার্যকর ব্যবস্থা। স্থানীয়রা বলছেন, গাজীপুরের প্রধান নদ-নদী তুরাগ, লবলং, মকশ বিল, বেলাই বিল শিল্পদূষণের ব্যাপক শিকার। এ এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি।
বিষয়টি উঠে এসেছে ‘দ্য এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ইমপ্যাক্টস অব আনপ্ল্যান্ড অ্যান্ড র্যাপিড ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন ইন সাবআরবান এরিয়াস: দ্য কেস অব দ্য গ্রেটার ঢাকা রিজিয়ন, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও। প্রতিবেদনটি এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড আরবানাইজেশন এশিয়ার ২০২১ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ইংল্যান্ডের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক।
গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নীতি ও পরিকল্পনার অভাবে দ্রুত শিল্পায়নের ফলে শহরতলি এলাকা বলে পরিচিত কোনাবাড়ী-কাশিমপুরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। বৃহত্তর ঢাকার দ্রুতবর্ধনশীল শহরতলি এলাকার মধ্যে অন্যতম কোনাবাড়ী-কাশিমপুর। এ এলাকার ৩৫৯টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্প এ এলাকার প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মূলত স্বল্পমূল্যের জমি, সুলভ শ্রম এবং মূল শহরের সঙ্গে ভালো পরিবহন যোগাযোগের সুযোগ থাকায় এ অঞ্চলে শিল্পায়ন বেড়েছে দ্রুত। আবার এ অঞ্চল ঘিরে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের বেশির ভাগই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। শ্রমঘন এ শিল্পকে ঘিরে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও গড়ে উঠেছে। ফলে স্থানীয়দের আয়ের সুযোগ বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। তবে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এ শহরতলির প্রাকৃতিক পরিবেশ, অবকাঠামো এবং সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিল্পের জন্য জমি এবং শ্রমিকদের আবাসনের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। মৌলিক পরিষেবা অবকাঠামো এবং নগর সুযোগ-সুবিধা জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি।
গবেষণা প্রতিবেদনটি নিয়ে কথা হয় গবেষকদের একজন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে নব্বইয়ের দশকের পর শিল্প খাতে, বিশেষ করে পোশাক খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ঢাকায় যখন এ শ্রমঘন কারখানা করার জন্য জায়গা মিলছিল না, ২০০০ সালের পর থেকে তা পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর হতে থাকে ঢাকা শহরের বাইরের দিকে। বিশেষ করে গাজীপুর এরিয়ায় পোশাক খাতের বড় সম্প্রসারণ হয়েছে। স্থানীয় কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ না থাকায় পোশাক খাত ঘিরে আবাসনসহ অন্যান্য যেসব সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই এ অঞ্চলকে ঘিরে শিল্পায়নের ফলে এ এলাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন হারিয়েছে, তেমনি বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আবার এখানকার শ্রমঘন এ শিল্পকে ঘিরে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খাত ও শিল্প এত দ্রুত গড়ে উঠেছে তার কোনোটিই সেভাবে নিয়ম-কানুন মেনে গড়ে ওঠেনি। ফলে এখানে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বাড়লেও জীবনযাত্রার মান হয়ে পড়েছে নিম্নমুখী। আবার অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা পরিবেশের জন্যও বিরূপ প্রভাব বয়ে নিয়ে আসছে।
প্রতিবেদনে একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তার বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ বছর ধরে তিনি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। ওই এলাকায় যখন পোশাক কারখানা স্থাপন করা শুরু হলো, তখন তিনি তার অর্ধেক জমি একটি কারখানা মালিকের কাছে বিক্রি করে দেন। সেই টাকায় বাকি অর্ধেক জমিতে ১২০টি সেমিপাকা ঘর তুলে ভাড়া দেন। প্রতি মাসে সেখান থেকে তিনি দেড় লাখ টাকা আয় করেন। তবে শিক্ষকতা তার আবেগের জায়গায় থাকায় এখনো পেশাটি ধরে রেখেছেন। এ স্কুলশিক্ষকের মতো স্থানীয় প্রায় সবারই আয় বেড়েছে। ফলে এ অঞ্চল ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মতত্পরতা আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশের যত শ্রমঘন শিল্প-কারখানা রয়েছে তার একটি বড় অংশই ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এসব এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তুলনামূলক ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় গাজীপুরের আশপাশে পোশাক শিল্পের বিস্তৃতি হয়েছে দ্রুত। তবে শ্রমঘন এ শিল্প এলাকাটি গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। গুরুত্ব দেয়া হয়নি এ খাতটিতে কর্মরতদের আবাসনের বিষয়ে। কারখানা সম্প্রসারণের বিষয়টিতে যতটা উদ্যোগী ছিলেন উদ্যোক্তরা সেই খাতে কর্মরতদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে তাদের। স্বল্প মজুরিতে এসব শিল্পের কর্মীদের জন্য গড়ে উঠেছে ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন আবাসন। ঘিঞ্জি পরিবেশে অল্প জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব বসতিতে নেই জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা।
বিষয়টি নিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ—এ তিন জেলায় সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন হয়েছে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে এসব শিল্পে যারা কাজ করবেন, তাদের যে ধরনের আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল সেটি গড়ে ওঠেনি। এসব জেলায় আবাসনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ব্যক্তি উদ্যোগে। বেশির ভাগ আবাসনের অবস্থা খুবই খারাপ। খুবই নিম্নমানের এসব আবাসনে একত্রে অনেকে থাকছেন, পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি এসব জেলার আবাসনে মনোযোগ দেয়া হতো, তাহলে এখানে কর্মরতদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিছুটা হলেও কম হতো। সামনের দিনে আমাদের শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। শহরের জনসংখ্যা এবং ঘনত্ব নিয়ে পুনর্ভাবনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে শহর এলাকাতে নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের মানসম্মত আবাসন পরিকল্পনা করা দরকার।