কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরে সম্মানসূচক স্বর্ণপাম পাচ্ছেন অস্কারজয়ী অভিনেতা ফরেস্ট হুইটেকার। আগামী ১৭ মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে থাকবেন ৬০ বছর বয়সী এই আমেরিকান তারকা। ফরেস্ট হুইটেকারের শিল্পীসুলভ চমৎকার পরিভ্রমণ, সহজাত সৃজনশীল দক্ষতা, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সংকটে বিচক্ষণ ও বলিষ্ঠ প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান জানাতে তাকে দেওয়া হবে স্বর্ণপাম।
কান উৎসবের জেনারেল ডেলিগেট থিয়েরি ফ্রেমোঁ বলেন, ‘ফরেস্ট হুইটেকার অনন্যসাধারণ প্রতিভাবান ও আলোকিত একজন শিল্পী। চলচ্চিত্র জগতে তার কাজের তালিকা একইসঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ও মার্জিত। মানুষ হিসেবে তার প্রত্যয় এবং নতুন প্রজন্মের প্রতি মনোযোগ আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। উন্নত বিশ্বে নিজের বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তিনি একটি ভালো জায়গা তৈরিতে অবদান রাখছেন। এত সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন অসাধারণ শিল্পীরা, ফরেস্ট হুইটেকার সেটি অর্জনের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’
কান উৎসবের সভাপতি পিয়েরে লেসকিউরের কথায়, ‘যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাদের সম্মান জানানো কান উৎসবের ঐতিহ্য, ফরেস্ট হুইটেকার তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বিশ্বের নিপীড়িত ও প্রতিকূলতার সঙ্গে মোকাবিলা করা মানুষের তরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এবারের স্বর্ণপাম হলো চলচ্চিত্র জগতের তরফ থেকে একটি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।’
এক বিবৃতিতে ফরেস্ট হুইটেকার বলেন, ‘৩৪ বছর আগে প্রথমবারে কান উৎসবে অংশগ্রহণ করে আমার জীবন বদলে যায়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানবতার মাঝে সংযোগ খুঁজে পেতে নিজেকে নিয়োজিত করার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আত্মবিশ্বাস পেয়েছি তখনই। সুন্দর এই উৎসবে নিজের কাজ নিয়ে ফিরে আসা এবং বিশ্বের সেরা শিল্পীদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হওয়া বরাবরই বিশেষ ব্যাপার। কানের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ৭৫তম আসরের অংশ হতে পারছি বলে আমি দারুণ সম্মানিত।’
১৯৮৮ সালের কান উৎসবে ক্লিন্ট ইস্টউডের ‘বার্ড’ ছবির সুবাদে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন ফরেস্ট হুইটেকার। এটি ছিল জ্যাজ স্যাক্সোফোনিস্ট চার্লি পার্কারের বায়োপিক। এর মাধ্যমে অভূতপূর্ব একজন অভিনেতাকে আবিষ্কার করে বিশ্ব। কানের স্পেশাল স্ক্রিনিং শাখায় আগামী ১৮ মে দেখানো হবে ফরেস্ট হুইটেকার প্রযোজিত নতুন ছবি ‘ফর দ্য সেক অব পিস’। এটি পরিচালনা করেছেন ক্রিস্তফ ক্যাস্তানে ও থমাস সামেটিন। এর প্রেক্ষাপট বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দেশ দক্ষিণ সুদান। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে এখন পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এমন অন্ধকারেও শান্তির আশার আলো খুঁজে বেড়ায় তরুণ-তরুণীরা। জুবার একটি শরণার্থী শিবিরের রেফারি গাটজং উপজাতি শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে শান্তির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে খেলাধুলাকে ব্যবহার করে। অন্যদিকে কিদেপো উপত্যকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী দ্বন্দ্ব মোকাবিলায় সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সফল মধ্যস্থতাকারী হয়ে ওঠেন অল্পবয়সী মা নান্দেগে। তাদের গল্পের মাধ্যমে মানবতার উন্মুক্ত পথের দেখা মেলে।
কান উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে এ নিয়ে ষষ্ঠবার জায়গা পেলেন ফরেস্ট হুইটেকার। এছাড়া প্রতিযোগিতা শাখায় নির্বাচিত হয় তার অভিনীত ‘বার্ড’, বিল ডিউকের ‘অ্যা রেজ ইন হারলেম’ (১৯৯১), আবেল ফেরারার ‘বডি স্ন্যাচার্স’ (১৯৯৩) এবং জিম জারমাশের ‘গোস্ট ডগ: দ্য ওয়ে অব দ্য সামুরাই’ (১৯৯৯)। ২০১৩ সালে কান উৎসবের সমাপনী ছবি ‘জুলু’তে অভিনয় করেছেন তিনি।
‘দ্য লাস্ট কিং অব স্কটল্যান্ড’ (২০০৬) ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য অস্কারে ও গোল্ডেন গ্লোবসে সেরা অভিনেতা হন ফরেস্ট হুইটেকার। তার ঝুলিতে আরও আছে মার্টিন স্করসেজির ‘দ্য কালার অব মানি’ (১৯৮৬), অলিভার স্টোনের ‘প্লাটুন’ (১৯৮৬), ব্যারি লেভিনসনের ‘গুড মর্নিং, ভিয়েতনাম’ (১৯৮৭), ‘দ্য ক্রাইং গেম’ (১৯৯২), ‘স্মোক’ (১৯৯৫), ‘প্যানিক রুম’ (২০০২), ‘ফোন বুথ’ (২০০২), ‘স্ট্রিট কিংস’ (২০০৮), ‘ভানটেজ পয়েন্ট’ (২০০৮), ‘দ্য বাটলার’ (২০১৩), ‘সাউথপাউ’ (২০১৫), ‘রোগ ওয়ান: অ্যা স্টার ওয়ারস স্টোরি’ (২০১৬), ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ (২০১৮), ‘রেসপেক্ট’ (২০২১)। অভিনয়ের বাইরে চারটি ছবি পরিচালনা করেছেন ফরেস্ট হুইটেকার। এগুলো হলো ‘স্ট্র্যাপড’ (১৯৯৩), ‘ওয়েটিং টু এক্সহেল’ (১৯৯৫), ‘হোপ ফ্লোটস’ (১৯৯৮) এবং ‘ফার্স্ট ডটার’ (২০০৪)। ২০১৩ সালে কানের আঁ সাঁর্তে রিগা শাখায় নির্বাচিত রায়ান কুগলারের ‘ফ্রুটভেল স্টেশন’, ২০১৫ সালে কানের প্যারালাল শাখা ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে প্রদর্শিত ক্লোয়ি জাও পরিচালিত ‘সংস মাই ব্রাদারস টট মি’ এবং সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো ‘ডোপ’ (২০১৫) প্রযোজনা করেছেন ফরেস্ট হুইটেকার।
ফরেস্ট হুইটেকার ২০১২ সালে গড়ে তোলেন হুইটেকার পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউপিডিআই)। উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যামেরুন, চাদ, গ্যাবন এমনকি লস অ্যাঞ্জেলসে কাজ করে থাকে এই এনজিও। সশস্ত্র সংঘাত এবং সহিংসতাপ্রবণ দেশগুলোতে শান্তি ও অর্থনৈতিক সহনশীলতার জন্য সহায়তা দেয় ডব্লিউপিডিআই। ইতোমধ্যে ১৫ লাখেরও বেশি মানুষকে সাহায্য করেছে এনজিওটি। ডব্লিউপিডিআই’কে সহায়তা দিয়েছে আড়াই হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী এবং ১৪টি শিক্ষাকেন্দ্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি নেটওয়ার্ক। ফরেস্ট হুইটেকার ইউনেস্কোর শান্তি ও সৌহার্দ্যের বিশেষ দূত এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সদস্য।
২০০২ সাল থেকে কানে সম্মানসূচক স্বর্ণপাম দেওয়া হচ্ছে, যারা কখনো প্রতিযোগিতা শাখায় স্বর্ণপাম জেতেননি। এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য ইতালির বের্নার্দো বের্তোলুচ্চি, ফ্রান্সের নারী পরিচালক আনিয়েস ভারদা, আমেরিকান নির্মাতা উডি অ্যালেন, ক্লিন্ট ইস্টউড, অভিনেত্রী জেন ফন্ডা, জোডি ফস্টার।