‘আবাসিক এলাকার বর্জ্য নেয়া হয়, বস্তির বর্জ্য নেয়া হয় না’- কথাটি পুরোনো হলেও বর্তমানে বেড়েছে তীব্রতা। বস্তির মানুষ নিজস্ব উদ্যোগে কিছু বর্জ্য সিটি করপোরেশনের বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রে (এসটিএস) পৌঁছে দিলেও বেশিরভাগই থেকে যায় বস্তিতে। বর্জ্য না নেয়ার ফলে বস্তি পরিণত হচ্ছে বর্জ্যের স্তূপে। এ বর্জ্য পানিতে যাচ্ছে, বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরি করছে। যার প্রভাব পড়ছে বস্তিবাসীর স্বাস্থ্যের ওপর। একদিকে যেমন দুর্গন্ধ, অন্যদিকে বর্জ্য পচে পানির সঙ্গে মিলে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তির আশপাশের আবাসিক এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের লোকজন ময়লা নিয়ে যায়, কিন্তু বস্তির ভেতরে সিটি করপোরেশনের লোক যায় না।
বস্তিবাসীর অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওরের (কাপ) নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার রেবেকা সান ইয়াত। তিনি বলেন, ঢাকার অধিকাংশ বস্তি থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। সিটি করপোরেশন ময়লা সংগ্রহে আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে। তারা বস্তি এলাকা থেকে ময়লা নেয় না। চিকিৎসকরা বলছেন, বর্জ্যের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশদূষণ রোধ করতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বড় ভূমিকা রাখে। ঢাকার বস্তিগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র করুণ, যা পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বস্তিবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিগত বছরগুলোতে বস্তি থেকে ময়লা টানা হতো। কিন্তু, বর্তমানে সেই ময়লা আর টানা হয় না। ফলে এখন সেই ময়লা বস্তিতেই থেকে যাচ্ছে। যার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না সিটি করপোরেশন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’-এর তথ্যানুসারে, দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৮টি। এসব বস্তিতে সাড়ে ২২ লাখ মানুষ বসবাস করে। আর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বস্তি রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪টি। এতে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ বসবাস করে। তবে বেসরকারি হিসাব বলছে, ঢাকায় পাঁচ হাজারের বেশি বস্তি রয়েছে। এতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। তাদের অধিকাংশ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাসের এই শহরে প্রতিদিন উৎপাদন হয় ৪৫ হাজার মেট্রিন টন বর্জ্য। শহরে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বর্জ্য উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে শহরগুলোয় গ্রামের তুলনায় জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় দিন দিন মানুষ শহরমুখী হয়ে উঠছে। ফলে শহরাঞ্চলে বর্জ্য উৎপন্নের পরিমাণ গ্রামের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা ব্যতীত দেশের অন্য বড় শহরগুলোর অবস্থাও অনেকাংশে একই। অতিরিক্ত পরিমাণ জনসংখ্যার চাপ ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের ক্রমান্বয় বৃদ্ধি, শহরগুলোর পরিবেশকে বসবাসের অযোগ্য করতে ভূমিকা রাখছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বস্তুতে এর সফলতা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিবেশ সংগঠনগুলোও এই সমস্যা সমাধানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দৃশ্যতায় সব কর্মসূচির সফলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।
গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়-৩ এ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা সভায় ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আজিজুন নেছা বলেন, বস্তিতে বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। না হলে বর্জ্যের কারণে পানি ও বায়ুদূষণ হবে। ময়লার কারণে বাতাসে দুর্গন্ধ এবং ক্ষতিকারক গ্যাস উৎপন্ন হয়ে নগরবাসী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে কড়াইলসহ রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ওই এলাকার লোকজন ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রকম পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পরে এই রোগ গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ শহরে ছড়িয়ে পড়ছে।
মো. নাজিম উদ্দিন ও মুর্শেদা বেগম দম্পতি। বসবাস করেন রাজধানীর হাজারীবাগের বউবাজার এলাকার আকবরের বস্তিতে। বস্তির পাশেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস)। তারা বলেন, আমাদের দুই সন্তান জন্ম থেকে চর্মরোগে ভুগছে। সারা শরীর ফোসকায় ভরে গেছে। একই বস্তিতে চার বছর বয়সি সন্তান নিয়ে বসবাস করেন রিকশাচালক আব্দুল হেকিম ও ফাতেমা দম্পতি। আব্দুল হেকিম বলেন, আমার মেয়েটা ময়লার স্তূপে খেলাধুলা করে। কিছুদিন আগেও তার ডায়রিয়া হইছে। শুধু হাজারীবাগের আকবর বস্তিতেই দৃশ্যচিত্র এমন নয়। অস্বাস্থ্যকর এমন পরিবেশে বসবাস করছেন রাজধানীর অধিকাংশ বস্তিবাসী। তাদের এমন কষ্টের কথার অবমূল্যায়নে পরিবার নিয়ে হতাশ আর দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তারা।
কথা হয় মোহাম্মদপুরে কাঁটাশুরে অবস্থিত বস্তির বাসিন্দা মো. নূর উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের পাশে আবাসিক এলাকা থেকে প্রতিদিন সকালে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু আমাদের এই বস্তিতে ময়লা সংগ্রহ করতে কেউই আসে না। ফলে আমাদের এখানে জমানো বর্জ্যগুলো আমরা জমা করে রেখে দেই। মাঝে মধ্যে বর্জ্যের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে সিটি করপোরেশনের গাড়িতে ফেলে আসি। এভাবে আর কতদিন। আমরা তো নগরীরই বাসিন্দা। তাহলে সবখান থেকে ময়লা সংগ্রহ করা হয় বস্তি থেকে কেন ময়লা সংগ্রহ করা হয় না?
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এস এম শরিফ উল ইসলাম বলেন, বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করার কাজটি সিটি করপোরেশন পরিচালনা করে না। এটা পরিচালনা করে ভ্যানগাড়িওয়ালা বা বিভিন্ন সংস্থা। তারা এসটিএস-এ ময়লা রাখে সিটি করপোরেশন সেই ময়লাগুলো সাভার বা মাতুয়াইলে নিয়ে যায়। তবে আমরা বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। কোরবানি ঈদের পর ইনশাআল্লাহ এর একটা সমাধান আসবে। তিনি বলেন, বর্জ্য সংগ্রহ না করার বিষয়টি নিয়ে আপনি যে বস্তিগুলোর কথা বলেছেন আমরা সেগুলোর দিকে নজর দিচ্ছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, বস্তি থেকে নেয়া হয় না, বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে দেখা যাবে বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি পরিচালনা করছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু এই কাজটা করার কথা সিটি করপোরেশনের। এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বস্তি থেকে ময়লা সংগ্রহ না করায় বস্তিবাসী সেই ময়লা পলিতে করে বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় ফেলে রাখছে অথবা পুড়িয়ে ফেলছে। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। আন্তর্জাতিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তো খারাপই, দেশের যে অবস্থান ওয়েজো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো খারাপ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হলে অবশ্যই এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। এই বিষয়কে জোরালোভাবে দেখতে হবে।