আইপিএল নাকি টেস্ট
ক্রিকেট? আচ্ছা, বিরাট কোহলিকে যদি আইপিএল ও টেস্ট ক্রিকেটের মধ্যে একটি বেছে নিতে
বলা হয়, তিনি কোনটি খেলতে চাইবেন? প্রশ্নটা আর শুধুই একটি ‘কুইজ’ নয়! এমন জটিল প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে
হয় আজকালকার আধুনিক ক্রিকেটারদের।
আইপিএলের সময়ে
ভারতের সিরিজ থাকে না বলে সে প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয় না কোহলিদের। কিন্তু অন্য অনেক
দেশের ক্রিকেটারদেরই এই প্রশ্ন ফেলে দেয় মহাপরীক্ষায়। এই যেমন সর্বশেষ ঘটনাটা দক্ষিণ
আফ্রিকার। আইপিএলের সময়েই প্রোটিয়াদের টেস্ট সিরিজ ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকার
স্কোয়াডের ছয় সদস্য আবার আইপিএলের দলেও ছিলেন। তাঁদের সামনে তাই একেবারে সোজাসুজিই
ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রশ্নটা।
তাঁরা কোনটি বেছে
নিয়েছেন, সেটি আপনার যদি জানা না ও থাকে, তবু তা অনুমান করে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
টেস্ট ক্রিকেট তাঁরা কেন বেছে নেননি, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। ফাফ ডু প্লেসি টেস্ট ক্রিকেট
তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর ক্যারিয়ার আরও দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে। টেস্ট ক্রিকেটকে
তো বলা হয় মর্যাদার ফরম্যাট! বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেটকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন উইলিয়ামসন-স্মিথরাও।
কিন্তু সেই সঙ্গে
মর্যাদার এই ফরম্যাটটাকে উপভোগ না করাদের আজকাল পাওয়া যে যায় না, তা কিন্তু না! গত
বছরেই মঈন আলী টেস্টকে ‘বিদায়’ বলে দিয়েছিলেন,
সাদা পোশাকের ক্রিকেটটা তিনি আর উপভোগ করছিলেন না। টি-টোয়েন্টি ও আইপিএলের যুগে বেড়ে
ওঠা অনেকেরই ফরম্যাটভেদে গুরুত্বের তালিকায় আজ আর অগ্রাধিকার পায় না টেস্ট ক্রিকেট।
তাই শুরুতে করা
ওই প্রশ্নের উত্তরটা হয় আইপিএল। তখন দেশ বড় না আইপিএল বড় জোরদার হয় সে আলোচনাও। সে
প্রসঙ্গে আপাতত না-ই যাওয়া যাক। তবে ক্রিকেটের নতুন এই বাস্তবতার সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত
হচ্ছে বাংলাদেশও। দুই ধরনের উদাহরণই যে এখন পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে। সাকিবের ছুটি,
বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। আর ছুটির কারণটা আইপিএল হলে তো হলোই!
সাকিব আল হাসানকেও
ওই মহাপরীক্ষায় ফেলে দেওয়া প্রশ্নটার মুখে পড়তে হয়েছিল ২০২১ সালের শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে।
ওই সিরিজের সময়েই যে আইপিএলের আসরও ছিল। আর সাকিব বোর্ডকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি
শ্রীলঙ্কা সিরিজ থেকে ছুটি চান আইপিএল খেলার জন্যই। সাকিবের আইপিএলের খেলার কথা যখন
উঠেছে, মোস্তাফিজও আসবেন সেখানে।
মোস্তাফিজ যে
টেস্ট খেলেন না বা টেস্ট উপভোগ করেন না, তত দিনে তা একধরনের প্রতিষ্ঠিতই। তবু সে সময়
আবারও উঠল প্রশ্নটা। দলে থাকলে অবশ্যই টেস্ট খেলবেন জানিয়ে দিয়ে মোস্তাফিজ তখন পরিণত
প্রশংসার পাত্রে। পরে অবশ্য মোস্তাফিজ আইপিএল খেলতেই গিয়েছিলেন। সেই মোস্তাফিজই আবার
সর্বশেষ কেন্দ্রীয় চুক্তিতে টেস্টে নিজের নাম লেখাননি।
বায়ো-বাবলের কঠিন
জীবনের কারণ দেখিয়েছিলেন তিনি। এবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে মোস্তাফিজের টেস্ট
খেলতে অনীহার কথাটা খোলামেলাই জানা গেল। ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে মোস্তাফিজ মনে করেন,
কিছু ত্যাগ করতে হবে। আর সেই ত্যাগ, টেস্ট ক্রিকেট! মোস্তাফিজের বয়স ২৬ পেরোয়নি এখনো।
কিন্তু সেই মোস্তাফিজের মনে এখন থেকেই ক্যারিয়ার লম্বা করার চিন্তা ঢুকে গেল?
সাকিব ও মোস্তাফিজ—বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই দুই ক্রিকেটারের
যেকোনো দলে থাকাটাই তো লাভ। কিন্তু বিসিবি ক্রিকেটারদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল, কে কোন
ফরম্যাটে খেলতে চান। সে অনুযায়ী মোস্তাফিজের খেলতে চাওয়া ফরম্যাটের তালিকায় টেস্ট জায়গা
পায়নি। তখন অবশ্য বিসিবি জোর গলায়ই বারবার বলেছিল, কেউ না খেলতে চাইলে জোর করা হবে
না।
এখন আবার মোস্তাফিজের
শ্রীলঙ্কা সিরিজে খেলার প্রয়োজনীয়তার কথা উঠল, তখন বলা হলো, প্রয়োজন হলে অবশ্যই খেলানো
হবে! আইপিএল খেলতে দেওয়া মোস্তাফিজকে ফেরানোর কথা উঠলেও প্রথম টেস্টের দলে রাখা হয়নি
অবশ্য মোস্তাফিজকে। ক্রিকেট আধুনিক হচ্ছে, আর ক্রিকেটের গায়েও লাগছে নিত্যনতুন পরিবর্তনের
হাওয়া!
আর এই আধুনিক
যুগে ক্রিকেটকে দেখতে হচ্ছে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে দেশের ক্রিকেটকে না বলছেন
ক্রিকেটাররা, যুগে যুগে মর্যাদার আসনে বসে আসা টেস্ট ক্রিকেটটার জায়গা হচ্ছে ‘অবহেলার’ আসনে। বাংলাদেশ ক্রিকেটও আধুনিক এই ক্রিকেটের
সঙ্গে আজ পাল্লা দিয়ে চলছে। সেটাকে দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য, কোনটা বলবেন?
বিশ্ব ক্রিকেটই
এখন মুখোমুখি হচ্ছে নতুন এই বাস্তবতার সঙ্গে। সাকিবের ছুটির ঘটনা এবং মোস্তাফিজের ক্যারিয়ার
দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্য দুটিতেও তাই ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের অনেক ইতিহাস তৈরিতে হাত
থাকা এ দুজন এবার পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন এক বাস্তবতার সঙ্গেও। এবার এই বাস্তবতার সঙ্গে
বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে কোন রূপে?
এই তো আইপিএল
খেলতে চাওয়ার কারণে সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজ খেলতে চাননি সাকিব। সে নিয়ে
কি কম বিতর্ক হলো! শেষমেশ সাকিব ‘খেলার অবস্থায় নেই’ জানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর না করতে চেয়েও
পরে গিয়েছিলেন। যদিও পরে ব্যক্তিগত কারণে টেস্টে না খেলে ওয়ানডে সিরিজ খেলেই ফিরে আসতে
হয়েছিল তাঁকে।
অবশ্য দক্ষিণ
আফ্রিকায় টেস্ট যে কারণে প্রথমে না খেলার মত জানিয়েছিলেন, এরপর সেই আইপিএলেই আর দল
পাননি সাকিব। যদি ভবিষ্যতে আবার আইপিএল ও বাংলাদেশের কোনো সিরিজ কিংবা নির্দিষ্ট করে
বললে টেস্ট সিরিজের মধ্যে কোনো একটা বেছে নিতে গিয়ে সাকিব আইপিএলই বেছে নেন, তখন বিসিবি
কী করবে? ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে চাইলে মোস্তাফিজ কেন তাহলে অন্য ফরম্যাট ছাড়ছেন না?
মোস্তাফিজ এ প্রশ্নের
উত্তরে যুক্তি দেখিয়েছেন, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তাঁর সাফল্য তুলনামূলক বেশি বলে টেস্টটা
বাদ দিচ্ছেন। মোস্তাফিজের মনে কেন এ ভাবনার উদয় হয় না, যে টেস্টে ভালো করতেই হবে। টেস্টে
ভালো করার চ্যালেঞ্জ না নিলেও মোস্তাফিজকে বিসিবি কি টেস্টে ফেরাতে পারবে? এবং ফেরালেও
যদি মোস্তাফিজও কখনো চেয়ে বসেন ছুটি, তখন? শুরুতে করা প্রশ্নটা তো বিসিবিকেও ফেলে দেবে
মহাপরীক্ষায়!