বিজয়ের আগেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পাওয়া
বাংলাদেশ একে একে পার করলো ৫০টি বছর। একসময়ের নিম্ন আয়ের ‘গরিব’ এই দেশ এরই মধ্যে
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে। তবে অর্থনীতি, সামাজিক,
সাংস্কৃতিক; বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের মাঝে আছে কিছু অপূর্ণতাও। আক্ষেপ রয়েছে—যার হাত ধরে এ
দেশের স্বাধীনতা এসেছে সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত
পথে হাঁটতে গিয়ে এখনও প্রায়শই হোঁচট খাচ্ছে পঞ্চাশের বাংলাদেশ। অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও
রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে পরিচালিত হতে পারছে না বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এখনও জঙ্গিবাদ,
সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদী-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির আস্ফালনও দেখা যায়। অবশ্য এসব
আক্ষেপ করেও বিশিষ্টজনরা বলছেন, কাগজে-কলমে বয়স ৫০ হলেও প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ কেবলই
২৩-২৪ বছরের। ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের কার্যত সলিল সমাধি ঘটেছিল। আর এর ফাঁকে পাওয়া
এই ২৩-২৪ বছরেই সমৃদ্ধশালী ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে
বাংলাদেশ, আছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ডও।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশ
নিয়ে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। বিশিষ্টজনরা আরও বলছেন, স্বাধীনতার
মহান স্থপতি জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব
চলে যাওয়া আর ঘনঘন ক্ষমতার পালা বদলে বারবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ভুলণ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী
শক্তি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা
করেছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর পথে হাঁটতে চাইলেও
তা কতটা সম্ভব হয়েছে—তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, পঞ্চাশের বাংলাদেশ নিয়ে কেন এত মাতামাতি
আমি বুঝতে পারছি না। আমরা তো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে হাঁটতে শিখিনি। ১৯৭৫-১৯৯৬ এবং
২০০১-২০০৭; এই সময়গুলো প্রকৃত বাংলাদেশ ছিল না। এ সময় দেশ ছিনতাই হয়েছিল; এ সময়ে যারা
দেশ শাসন করেছেন, তারা বাংলাদেশের আর্দশ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়
বিশ্বাসী ছিল না। কাজেই কার্যত পঞ্চাশ বছর আমরা পাইনি।
‘মূলত দেশ তার
পথে ২৩-২৪ বছরের মতো পেয়েছে’ উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে
বাংলাদেশের বৈষয়িক অর্জন হয়েছে অনেক। কিন্তু সেটাও উন্নতি, উন্নয়ন নয়। তার কারণ হচ্ছে
আমার বিচারে উন্নয়নের সংজ্ঞা হলো সমতা, সহ-প্রবৃদ্ধি। কিন্তু বাংলাদেশে বৈষম্য আছে,
যা বর্তমান মহামারি করোনার সময়ে আরও বেড়েছে। এই বৈষম্য কমানোর সরকারের পক্ষ থেকে কোনও
উদ্যোগ আমি দেখছি না। বৈষম্য কমাতে হলে কর্মসংস্থান বাড়াতে হয়, তা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাদী শক্তিগুলো
বাংলাদেশকে যতই পিট চাপড়াক না কেন, আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি করেছে
অনেক, প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের পূর্বশর্ত, সেই প্রবৃদ্ধি জনগণকে স্পর্শ করেনি। তৃণমূলের
মানুষ এখনও উন্নতির বাইরে রয়ে গেছে।’
গাণিতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক অনেক প্রবৃদ্ধি
হয়েছে, যা আমাদের আত্মপ্রসাদ দেয়—মন্তব্য করে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
বলেন, ‘গাণিতিক পরিসংখ্যানের
বাইরেও বাংলাদেশ আছে। বৈষয়িক প্রবৃদ্ধি হলেও ভবিষ্যততো ধসে গেছে, মানুষের জীবনমান নীচে
নেমে গেছে। শিক্ষাখাতে হযবরল অবস্থা। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকটা, যার জন্য আমি
গর্বিত। কিন্তু যেতে হবে আরও বহুদূর। যেতে হবে সঠিক পথে; সঠিক পথ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর
দেখানো পথ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশ সমতুল্য নয়।’
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য
বলেন, ‘৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের
মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করেছি আমরা। বাংলাদেশ আজ ৫০ বছর পূর্ণ করলো। তার আগের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম,
জনগণের অংশগ্রহণ, গণজাগরণ, বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব এবং প্রায় ২৩ বছর এক নাগাড়ে
লড়াই সংগ্রাম করে একটা জাতি তার নবজন্ম ঘটালো, গণঅভ্যূত্থানের মধ্যে প্রবেশ করলো মুক্তিযুদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে ২৫
মার্চের গণহত্যার পরে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। জনগণের ভূমিকা, সেটা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ
করতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দলের ঐক্য ছিল না। এখান থেকেও আমাদের শিক্ষা
নেওয়া দরকার। আজকে সেই বিজয়ের সাফল্য আমরা ভোগ করছি ৫০ বছর ধরে।’
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘সেই স্বাধীন বাংলাদেশ,
পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং স্বাধীন অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে। মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে
আছে। এ জন্য জন্মদিনে কৃতজ্ঞতা থাকা দরকার ভারতে প্রতি।’
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য
বলেন, ‘আমরা পা রাখছি
৫০ বছরে। এর মধ্যে সমৃদ্ধ জাতির দিকে আমরা যাত্রা শুরু করেছি— সেটা যেমন সত্য,
তেমনি আরেকটি সত্য হলো—আমাদের ছন্দপতন ঘটেয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫
আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। সেখানে সামরিক শাষণ, মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতা,
জিয়া-এরশাদ এবং পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার শাসনে প্রায় ২০ বছরের ওপরে। সেই একটি পাকিস্তানমুখী
পথযাত্রা আমরা দেখলাম।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের
পুনর্বাসন হলো, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ দশা থেকে মুক্ত হলো, সেখানে
বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের পুর্নবাসন এবং সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসানো—এই পাকিস্তামুখী
অবস্থা থেকে আবার ফিরে আসা—এটা অকল্পনীয় একটি কাজ। এই কাজটি সমাধান
হলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।’
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি
৮১ সালে ফিরে এলেন। আওয়ামী লীগ আবার শক্তিশালী হলো। দেশটা আবার গণতন্ত্রের পথে হাঁটা
শুরু করলো। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রথমে ক্ষমতায় এলেন, এরপর একনাগাড়ে ক্ষমতাসীন
আছেন। সেখানে বিরাট সাফল্য অর্জন তিনি করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের
বিচার তিনি সুসম্পন্ন করেছেন। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নকামী দেশে পরিণত
করার পথে প্রচুর অবদান রেখেছেন। পাশাপাশি পঞ্চাশের বাংলাদেশে কিছু আত্মিক ত্রুটি রয়ে
গেছে এখনও।’
‘গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ
হয়নি, এখনও সংকটমুক্ত হয়নি’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ভাষায়
জনগণ ক্ষমতার মালিক, সেই জনগণের মালিকানা নিয়ে চলছে কিনা সেটা কঠিন প্রশ্ন। পঞ্চাশের
বাংলাদেশকে এগুলো থেকে মুক্তি দিতে হবে এবং যে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশটাকে
স্বাধীন করলাম সেই স্বাধীন বাংলাদেশে অন্ততপক্ষে দেশবাসী গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করবে।
এ দেশে যারা কথা বলেন, তাদের এখন ভেবেচিন্তে, সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসরির যোদ্ধা এই রাজনৈতিক
নেতা আরও বলেন, ‘স্বাধীন-মুক্ত বাংলাদেশ, মুক্ত গণতান্ত্রিক
অধিকার পঞ্চাশের বাংলাদেশের কাছে আমার চাওয়া। একই সঙ্গে এটাও চাই যে, বাংলাদেশ প্রকৃতভাবে
যে অর্গানগুলো ঠিক করেছিল, তার মধ্যে জাতীয় চার মূলনীতির জায়গায় আমাদের ফেরত যেতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আবার পুনর্প্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। জনগণ
মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখে গেছে এবং দেশ গঠনে সে জনগণকে আবার আস্থাবান করে দেশের উপরে
রাজনীতির উপরে এবং সংবিধানের উপরে আস্থাবান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মঞ্চ গড়ে তুলে
সমস্ত নাগরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ঐকবদ্ধ্য করে দেশটাকে এগিয়ে নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘পেছনের রাস্তায়
আর হাঁটা যাবে না। অগণতান্ত্রিক পরিবেশ পঞ্চাশের বাংলাদেশে দেখতে চাই না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের
শিক্ষক সনাৎ কুমার সাহা বলেন, ‘বাস্তবের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি
এই পঞ্চাশ বছরে কী আমরা এগিয়েছি? কী পিছিয়েছি? নাকি একই জায়গায় আছি—এটা এক কথায় উত্তর
দেওয়া মুশকিল। তখন ছিলাম সাত কোটির ওপরে মানুষ, এখন ১৭ কোটি। দেশের আয়তন কিন্তু একই
আছে। কাজেই আমাদের জীবনের বাঁকগুলো স্পষ্ট হয়েছে।’
এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘তবে, একটা ব্যাপার
ভাবা দরকার যারা মনে করেন দেশে এখন উন্নয়নের জেয়ার বইছে, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে,
আমরা অনেক বেশী সমৃদ্ধ হয়েছি—এর ভেতরে সত্যি যে কিছু নেই তা
নয়, আমরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছি এটা বড় অর্জন।’
পঞ্চাশের বাংলাদেশে ‘জন আধিক্যে একটা সংকট তৈরি করছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে প্রতি বর্গমাইলে ১২শ’ থেকে ১৪শ’ মানুষ বাস করতো, এখন সাড়ে ৩ হাজার বাস করে। এর ফলে প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ুর ওপর যে চাপ; সেই চাপটায় আমি মনে করি, পারস্পারিক সৌহার্দ, বোঝাপড়া সেটা অনেকখানি ক্ষয় হয়েছে, সেটা আরও ক্ষয় পাবে। কারণ দেশের আয়তন বাড়ছে না।’