শ্রীলংকায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভের উদগিরণ এখনো বন্ধ হয়নি। জনবিক্ষোভের মুখে আত্মগোপনে চলে গিয়েছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। বিশেষ করে সরকারের পক্ষে যে রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন তারা একেবারেই প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন না। এরই মধ্যে জনরোষে ধ্বংস হয়েছে অনেকের বাড়িঘর। শ্রীলংকা পরিস্থিতি এখন ভীষণ উত্তপ্ত। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর এখন বিক্ষোভকারীদের দাবি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ। সে দাবি আদায়ে এখনো আন্দোলন-বিক্ষোভ চলছে।
দেশটিতে যে পরিস্থিতি চলমান, তা একদিনে তৈরি হয়নি। মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে এখন যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, একসময় তা ছিল ভালোবাসা। তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের দমনের কারণে বেশির ভাগ সিংহলির কাছে বীরে পরিণত হয়েছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকসে, কিন্তু এখন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে জাতীয় ভিলেনে পরিণত হয়েছেন।
রাজাপাকসে ভাইয়েরা, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে সবসময়ই একে অন্যের পাশে থেকেছেন। কিন্তু পদত্যাগের প্রশ্নে সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সোমবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মাহিন্দা। এর আগে এক বিশেষ বৈঠকে ভাইকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। কয়েকজন মন্ত্রী এ বিষয়ে মত দিলে পদত্যাগে সায় দেন মাহিন্দা। এর আগে পার্লামেন্টে দেশটির এক মন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে পদত্যাগ করবেন না দেশের প্রেসিডেন্ট। সোমবার সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা কলম্বোতে মাহিন্দা রাজাপাকসের বাসভবনে আগুন দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা কেবল আগুন দিয়ে আর ভাংচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি। হামলা করে সরকার সমর্থক ও রাজনীতিকদের ওপরও। সেদিনের সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় এক এমপিসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে কারফিউ ঘোষণা করা হলেও তা অমান্য করে পথে নেমে আসে বিক্ষোভকারীরা।
২০০৯ সাল ছিল মাহিন্দা রাজাপাকসের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। সেই সময় প্রথমবারের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও নিষ্ঠুর হিসেবে পরিচিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমকে (এলটিটিই) ধ্বংস করেন তিনি। যার মাধ্যমে শেষ হয় ৩০ বছর ধরে চলে আসা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এ ঘটনা মাহিন্দাকে রীতিমতো বীরের সম্মান এনে দেয়, সেটি দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিসরেও। এ অবদানের পেছনে ছিল গোটা রাজাপাকসে পরিবার। সেই সময় তাদের প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দল বলে আসলে কিছু ছিল না।
সেই সময় মাহিন্দা রাজাপাকসেকে জাতির পিতা, পতাকায় খচিত সিংহ বীর, বিশ্বের বিস্ময়সহ নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। আর ঠিক ১৩ বছর পর সেই মাহিন্দাকেই রীতিমতো ক্ষমতা থেকে উত্খাত করেছে দেশটির সাধারণ মানুষ। সেই মানুষগুলোই তার পতনের দাবিতে দিনের পর দিন রাজপথ আগলে রেখেছে, তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে, দাঁড়িয়েছে পুলিশের রাবার বুলেটের মুখোমুখি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক নানা সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলংকার জনগণের পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। নিত্যপণ্যের সংকট, অর্থাভাব, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, শিশুখাদ্য, জরুরি ওষুধসহ বেঁচে থাকার মতো সব অবলম্বন হারিয়ে পথে নামে দেশটির মানুষ। আর নিজেদের এসব সংকটের কারণে দেশের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ও সর্বোপরি রাজাপাকসে পরিবার নিয়ন্ত্রিত সরকারকেই দুষছে তারা। রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা, অর্থের অপচয়সহ নানা কারণে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। এর সঙ্গে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির রেশ তো ছিলই। তবে সরকার দুষছে কভিড মহামারীকে। এর কারণেই ধসে পড়ে দেশটির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় স্তম্ভ পর্যটন শিল্প।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয় শ্রীলংকা। এর পর থেকে এবারই প্রথম এমন চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠেকেছে তলানিতে। এমন অবস্থায় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে জরুরি অর্থসহায়তা চাইতে হয়েছে। তবে দেশ হিসেবে শ্রীলংকা ক্রমেই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হলেও সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছে রাজাপাকসে পরিবার। প্যান্ডোরা পেপার্সে উঠে এসেছে মাহিন্দা ও গোতাবায়ার ভাতিজি নিরুপমা রাজাপাকসে ও তার স্বামী থিরুক্কুমারান নাদেসানের বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার ও অনুমোদনহীন বিনিয়োগের তথ্য। নিরুপমা অবশ্য এরই মধ্যে শ্রীলংকা ছেড়েছেন।
২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এর পর থেকে শ্রীলংকার রাজনীতিতে উত্থান ঘটে রাজাপাকসে পরিবারের। স্পিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা সচিবসহ বড় পদে নিয়োগ পান এ পরিবারের সদস্যরা। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রধানের দায়িত্বও পান পরিবারের সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল বৈভবের মালিকানা গেছে এ পরিবারে। রাজাপাকসে ভাইদের বাবা শ্রীলংকার সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার ডন আলভিন রাজাপাকসের মৃত্যু হয়েছিল প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায়। সেখান থেকে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অন্যতম ধনী পরিবারে পরিণত হয়েছে তার পরিবার। সেই প্রভাবশালী পরিবারের বিরুদ্ধেই এখন রাজপথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। কেবল মাহিন্দাই নয়, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেরও পদত্যাগ চাইছে তারা।