সোনালি আঁশ
পাটের জন্য খ্যাত ফরিদপুর জেলা। এই জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান ‘সোনালি আঁশে ভরপুর/ ভালোবাসি ফরিদপুর’। এই জেলায় মানসম্পন্ন পাট উৎপাদিত হয়, যা পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত। জেলায়
রয়েছে বাইশটি জুটমিল। এসব মিলের উৎপাদিত পাটপণ্য সুতা রফতানি করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে। কিন্তু ফেরিঘাটে যানজটের কারণে সেসব পণ্য চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে সময়মতো পৌঁছানো
সম্ভব হতো না। এ জন্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চুক্তির খেলাপ হতো মিল মালিকদের। ফেরিঘাট
থেকে ফিরে আসতো রফতানি পণ্যবাহী ট্রাক। ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন মিল মালিকরা।
বন্ধ থাকতো জুটমিল, শ্রমিকরা হয়ে পড়তেন কর্মহীন। পদ্মা সেতু চালুর ফলে পাটপণ্য রফতানিতে
এই ভোগান্তি আর থাকবে না।
পদ্মা সেতু
দিয়ে জুটমিল মালিকরা সময়মতো চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে যেতে পারবেন। সেখান থেকে বিদেশে
সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছাবে। লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা। এই এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরও
বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারবে। কর্মসংস্থান হবে বহু মানুষের।
ফরিদপুরের প্রাইড
জুট মিলস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মৃধা মো. বদিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের
মানুষের জন্য আশীর্বাদ। ব্যবসায়িকভাবে আমরা লাভবান হবো। আমরা পাট থেকে সুতা তৈরি করে
থাকি। ওই সুতা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করি। চট্টগ্রামে মালামাল পৌঁছাতে
ফেরিঘাট ব্যবহার করতে হতো। ফেরিঘাটে কখনও কখনও দুই থেকে তিন দিন যানজটে আটকে থাকতো
ট্রাক। সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে পারতাম না। জাহাজ ছেড়ে যেত, শিডিউল মেলাতে পারতাম না। বিদেশের
ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি অনেক সময় বাতিল হয়ে যেত। পণ্য ফেরত আনতে হতো, ব্যবসায়িকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু চালু হলে আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। অল্প
সময়ের মধ্যেই পণ্য চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পারবো।
ওই জুট মিলের
নারী শ্রমিক রাশেদা খাতুন বলেন, ‘ফেরিঘাটের যানজটের কারণে মাল নিয়ে ট্রাক আটকে থাকতো। এ জন্য বিদেশে সুতা
পাঠানো যেত না, ফেরত আনতে হতো। এ কারণে অনেক সময় মিল বন্ধ রাখতেন মালিকরা। এখন সেতু
চালু হলে এই সমস্যায় পড়তে হবে না। মিলও বন্ধ থাকবে না, আমাদের রোজগার ঠিক থাকবে।’
দাহমাশি জুট
ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জিএম (প্রশাসন ও অপারেশন) কর্নেল (অব.) আব্দুর রাজ্জাক বলেন,
‘পদ্মা
সেতু চালু হলে সময় বাঁচবে। সময় বাঁচলে অর্থ বাঁচবে, ফলে লাভবান হতে পারবো আমরা। আমরা
সাধারণত তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, এল সালভাদর, চায়না ও আমেরিকাতে পাট থেকে তৈরি সুতা
রফতানি করে থাকি। পদ্মা সেতু চালুর ফলে ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাবো। তা ছাড়া
প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ কমে যাবে। আগে ঘাটে ট্রাক আটকে থাকতো, ভাড়া বেশি দিতে হতো। সেতু
দিয়ে মালামাল এখন পাঠাতে পারবো। সময়ও বাঁচবে, খরচও কম হবে। আবার বায়ারদের সঙ্গে সম্পর্কও
ভালো থাকবে। ফেরিঘাটের যানজটের কারণে সময়মতো পোর্টে মালামাল পাঠাতে পারতাম না। এ কারণে
অনেক সময় জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে বা দেরি করে ছাড়ায় ভাড়া বেশি দিতে হতো। এখন আর তেমন কোনও
সমস্যা হবে না।’
ফরিদপুর চেম্বার
অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মহসিন শরিফ বলেন, জেলায় বাইশটি জুট মিল রয়েছে।
সেগুলোর মধ্যে ঊনিশটি চালু রয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটির জায়গা কিনে রাখা হয়েছে। সেগুলোর
অবকাঠামোগত কাজ শুরু হবে শিগগিরই। জুটমিল মালিকদের একটি বড় সমস্যা, তাদের উৎপাদিত পণ্য
শিপমেন্ট করা। অনেক সময় ফেরিঘাটের কারণে তারা পণ্য সঠিক সময়ে পাঠালেও ঘাটে আটকে থাকতো।
বায়ারদের কাছে সময়মতো মালামাল পৌঁছাতো না। অনেক বায়ার পণ্যচুক্তি বাতিল করতো। ক্ষতিগ্রস্ত
হয়ে পড়তেন ব্যবসায়ীরা, তারা কথা রাখতে পারতেন না শুধুমাত্র ফেরিঘাটের যানজটের কারণে।
পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে। শুধু জুটমিল মালিকরাই লাভবার হবেন তা নয়, এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিপ্লব
ঘটবে। এর সুফল পাবেন সবাই।
কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদফতর ফরিদপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ড. হজরত আলী বলেন, পাটের জন্য বিখ্যাত এই জেলা।
সোনালি আঁশের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে এই জেলার। চলতি মৌসুমে জেলার দেড় লক্ষাধিক চাষি পাটচাষ
করেছেন। জেলায় মোট এক লাখ ২৪ হাজার হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে এই মৌসুমে ৮৬ হাজার হেক্টর
জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে যা থেকে উৎপাদন হবে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ
বেল (১৮০ কেজিতে ১ বেল) পাট। জেলার জুটমিলগুলোতে এই এলাকার অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান
সৃষ্টি হয়েছে।